"গীবত"যে সব ক্ষেত্রে গীবত করা বৈধঃ

"গীবত"
যে সব ক্ষেত্রে গীবত করা বৈধঃ

ইমাম নববীর মতে,
যদিও গীবত করা হারাম, কোন কোন পরিস্থিতিতে গীবত করার অনুমোদন রয়েছে – যখন তা কোন মঙ্গলের জন্য করা হয়ে থাকে ৷ গীবত করার এ ক্ষমতা কেবলমাত্র একটা ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ কারণেই প্রদান করা যাবে, অন্যথায় এর অনুমতি দেয়া যাবে না ৷ নিম্নের ছয়টি কারণের যে কোন একটি কারণে গীবত করা যেতে পারে:

১.জুলুম/নিপীড়নের বিচার চাইতে – যে ব্যক্তি নিপীড়িত হয়েছে, তার জন্য এই অনুমতি রয়েছে যে, সে তার অবস্থা সম্পর্কে শাসক বা বিচারককে বা অন্য যে কাউকে অবগত করতে পারে, যার ক্ষমতা রয়েছে তাকে জালিমের বিরুদ্ধে সুবিচার দেয়ার ৷ তাকে উল্লেখ করতে হবে, “অমুক লোক আমার প্রতি অন্যায় করেছে” এবং “সে আমার সাথে এই করেছে” এবং “সে আমাকে দমিয়ে রেখেছে এভাবে” বা এরকম আরো তথ্য ৷

২.একটি মন্দকে পরিবর্তন করা এবং পাপীকে সঠিক পথের দিকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য চাওয়া- একজন ব্যক্তির উচিত, যার পক্ষে কোন মন্দ কাজ থামানো সম্ভব তাকে বলা, “অমুক ব্যক্তি এরকম করেছিল, ফলে আমি তাকে তা থেকে বিরত রাখি” বা এরকম কিছু ৷ তার লক্ষ্যই হবে মন্দকে সম্পূর্ণরূপে দূর করা ৷ যদি এ ধরনের কোন উদ্দেশ্য না থাকে, তবে তার জন্য কোন কথা উল্লেখ না করাই উত্তম ৷

৩.ফতোয়া (ইসলামী বিধান) চাওয়া/জানা – একজন ব্যক্তির উচিত একজন মুফতীকে (যিনি ফতোয়া দিতে পারেন) বলা: “আমার বাবা” বা “আমার ভাই” বা “এই এই ব্যক্তি আমার সাথে এইরূপ অন্যায় করেছে ৷ তার কি এটা করার অধিকার রয়েছে?” – “কিভাবে আমি সেটা বন্ধ করতে পারি এবং আমার উপর থেকে জুলুম বন্ধ করে আমার অধিকার আদায় করতে পারি?” এবং এরকম আরো তথ্য ৷ এমনিভাবে, একজন বলতে পারে যে, “আমার স্ত্রী এরূপ করেছে” বা “আমার স্বামী এরূপ করেছে” এবং এরকম আরো তথ্য ৷ প্রয়োজনের তাগিদে এ ধরনের ফতোয়া চাওয়া অনুমতিযোগ্য, কিন্তু সাবধানতা অবলম্বনের জন্য যে কারো উচিত এভাবে বলা, “একজন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কি বলেন – যে এরূপ করেছে?” বা “একজন স্বামীর ব্যাপারে” বা “একজন স্ত্রী সম্পর্কে যে এরূপ করেছিল” (আমার স্ত্রী এভাবে না বলে) ইত্যাদি ৷ এই পদ্ধতিতে, কাউকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না করেই লক্ষ্য অর্জন করা যায় ৷ যাহোক, একজন ব্যক্তির নামোল্লেখ করা এরকম পরিস্থিতিতে অনুমোদিত এ হাদীসের ভিত্তিতে যে, হিন্দ (রা.) একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জানান, “বস্তুত, আবু সুফিয়ান (তার স্বামী) একজন কৃপণ লোক ৷” এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে একথা বলা থেকে বিরত রাখেননি ৷

৪.মুসলিমদের পাপ সম্পর্কে সতর্ক করা এবং উপদেশ দেয়া – এর বেশ কয়েকটি দিক রয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে: কাউকে হাদীস বর্ণনা ও সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে অনির্ভরযোগ্য ঘোষণা করা ৷ ইজমা (মুসলিম স্কলারদের ঐক্যমত) অনুযায়ী এটি করা জায়েয ৷ বরং গুরুত্বের ভিত্তিতে এটি কখনও কখনও অবশ্যকর্তব্য হয় ৷ আরেকটি অবস্থা হচ্ছে, যখন কোন ব্যক্তি কারো সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়, বিবাহ, ব্যবসা, সম্পত্তি হস্তান্তরের সময়, দৈনন্দিন লেনদেন ও যেকোন কিছু হস্তান্তরের সময় বা অনুরূপ কোন পরিস্থিতে – আপনার জন্য ফরয সেই ব্যক্তিকে অপর ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে অবগত করা, যার সঙ্গে সে লেনদেন করতে যাচ্ছে – উপদেশের লক্ষ্যে ৷ যদি আপনার উদ্দেশ্য এ কথা বলাতেই অর্জিত হয় যে “তার সাথে ব্যবসায়িক লেনদেনে জড়ানো আপনার জন্য মঙ্গলজনক নয়” বা এটা বলাতেও, “আপনার এটা করা উচিত নয়” বা এধরনের কিছু, তবে সেটুকুতেই সারতে হবে; তাই বলে ঐ লোকটির অন্যান্য (প্রসঙ্গ বহির্ভূত) খারাপ দোষগুলো সম্পর্কে জানানো যাবে না ৷ আর যদি এতে কাজ না হয়, তবে আপনি নির্দিষ্টভাবে লোকটির অবস্থা সম্পর্কে তাকে অবগত করতে পারেন ৷

আর একটি অবস্থা হচেছ, যখন আপনি কাউকে এমন কোন লোকের কাছ থেকে কোন কিছু কিনতে দেখেন, যে নাকি চুরি, ব্যভিচার বা মদ্যপানের মত অপরাধের সাথে জড়িত ৷ তখন ক্রেতাকে এ সম্পর্কে অবগত করানো আপনার কর্তব্য, যেহেতু তিনি জানেন না ৷ এমনকি, এটা তখনও প্রযোজ্য যখন আপনি জানেন লোকটি যে বস্তুটি কিনতে যাচেছ তা ত্রুটিযুক্ত ৷

আর একটি ব্যাপার হচেছ যে, যখন আপনি কোন শিক্ষার্থীকে (দ্বীনের ক্ষেত্রে) দেখেন একজন বিদ‘আতী বা পথভ্রষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করছে এবং আপনি তার ক্ষতির আশংকা করেন ৷ তখন আপনি অবশ্যই সেই ছাত্রকে উপদেশ দেয়ার লক্ষ্যে সে ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে অবগত করবেন ৷ এক্ষেত্রে অনেক মানুষই ভুল করে থাকে, কেননা ব্যক্তিটি যার সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছেন তার ব্যাপারে তিনি ঈর্ষাপরায়ণ হতে পারেন বা শয়তান তাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, এভাবে যে, তিনি ভাবতে পারেন যে তিনি যেটা করছেন তা হচেছ নসীহত এবং সমবেদনা প্রকাশ করা ৷

সর্বশেষে যে অবস্থাটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, যখন কোন ব্যক্তি কোন নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে এবং সে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেনা কেননা সে উপযুক্ত নয় বা সে একজন অমনোযোগী বা পাপী ইত্যাদি ৷ এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তির উচিত অন্যরা যারা তার উপর নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাদের নিকট বিষয়টি জানানো, যাতে তাকে এই পদ থেকে সরানো যায় এবং একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া যায় ৷ অথবা, যাদের সে ব্যক্তিটির উপর ক্ষমতা রয়েছে তারা যেন তার সম্পর্কে জানতে পারেন, যেন তার দ্বারা যাতে ক্ষতি সাধন না হয় তার ব্যবস্থা করতে পারেন বা তাকে ভাল হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন বা অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন ৷

৫.যখন কেউ উন্মুক্তভাবে মন্দকর্ম বা বিদআতী কাজে লিপ্ত থাকে- এর উদাহরণ হচেছ যখন কেউ খোলাখুলিভাবে মদপান করে, লোকের টাকা আত্মসাৎ করে এবং তাদের নিকট থেকে অন্যায়ভাবে ট্যাক্স নেয় ইত্যাদি ৷ ফলে জনসাধারণের সামনে ঐ ব্যক্তিটি যে সকল কাজ করে, তা নিয়ে আলোচনা করা বা কথা বলা বৈধ ৷ কিন্তু ঐ লোকের অন্যান্য দোষত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা নিষিদ্ধ যতক্ষণ না সেগুলো ঐ ক্যাটাগরীতে পড়ে, যে সকল কারণে গীবত করা জায়েয ৷

৬.কোন ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা – কোন ব্যক্তি যদি লোকজনের নিকট তার ডাক নামে পরিচিত থাকে, যেমন ‘ঝাপসা চোখ বিশিষ্ট যিনি’, ‘যিনি খোঁড়ান’, ‘বধির লোকটি’, ‘অন্ধ লোকটি’, ‘টেরা চক্ষু বিশিষ্ট’, ‘চ্যাপ্টা নাকওয়ালা’, ইত্যাদি ৷ তাহলে তাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য এভাবে বলা জায়েয ৷ যাহোক, তাকে হেয় করার জন্য এরকম নামকরণ করা নিষিদ্ধ ৷ যদি তাকে অন্য কোনভাবে চিহ্নিত করা যায়, তবে তাকে সেভাবেই চিহ্নিত করা উচিত ৷

এগুলো হচ্ছে সেই ছয়টি অবস্থা যে ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয, যদি তা আলেমগণ যেভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে করা হয়ে থাকে ৷ সহীহ হাদীস থেকেও এসব পরিস্থিতে গীবত করার অনুমোদন পাওয়া যায় ৷

সহীহ আল বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রা) বলেছেন, একজন লোক রাসূল (সা.) নিকট তার গৃহে প্রবেশের অনুমতি চাইলে, তিনি বললেন: “তাকে আসার অনুমতি দাও, এবং সে তার আত্মীয়স্বজনের জন্য কত খারাপ ভাই ৷”
আল বুখারী এ হাদীসটিকে গীবত করার ক্ষেত্রে প্রমাণস্বরূপ ব্যবহার করেছেন ৷

ইবন মাসুদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, “আল্লাহর রাসূল (সা.) যুদ্ধলব্ধ সম্পদের একাংশ বন্টন করছিলেন, তো একজন আনসারী বলল, “আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, মোহাম্মদ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা রাখে না (অর্থাৎ, তিনি ন্যয্যভাবে বন্টন করেননি) ।” ফলে আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নিকট গেলাম এবং তাঁকে ব্যাপারটি জানালাম ৷ তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেল (অর্থাৎ তিনি রাগান্বিত হলেন) এবং বললেন: “আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ)-এঁর উপর রহম করুন ৷ বস্তুত তিনি এর চেয়ে গুরুতরভাবে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ধৈর্যশীল ছিলেন ।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

তাছাড়া হিন্দ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসটি রয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “বস্তুত আবু সুফিয়ান হচ্ছে একজন কৃপণ ব্যক্তি ৷”
এবং এ হাদীসটি যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ফাতিমা বিনতে কায়েসকে (রা.) বললেন (দু’জন পানিপ্রার্থীর প্রসঙ্গে): “মুয়াবিয়ার ক্ষেত্রে, সে হচ্ছে খুবই দরিদ্র এবং আবু জাহম এর ব্যাপারটি হচেছ, সে তার কাঁধ থেকে লাঠি নামায় না অর্থাৎ, ‘সে তার বউদের মারধর করে’ ৷” (সহীহ মুসলিম)

আশা করি উপরের ইমাম নববীর লেখাটুকু আপনারা কষ্ট করে পড়লেন এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
[সংগৃহীত] কপি ফেসবুকে.