আল হাদীদ ৪) তিনিই আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর আরশে সমাসীন হয়েছেন৷ ৪ যা কিছু মাটির মধ্যে প্রবেশ করে, যা কিছু তা থেকে বেরিয়ে আসে এবং যা কিছু আসমান থেকে অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু আসমানে উঠে যায় ৫ তা তিনি জানেন৷
আল্লাহর "ইস্তিওয়া আলাল আরশ"(কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়া) এর বিস্তারিত স্বরূপ অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন৷ খুব সম্ভবত সমগ্র বিশ্ব -জাহান সৃষ্টির পর মহান আল্লাহ কোন একটি স্থানকে তাঁর এ অসীম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র নির্ধারণ করেন এবং সেখানে নিজের আলোকে রশ্মির বিচরণকে কেন্দ্রীভূত করে দেন আর তারই নাম দেন "আরশ" (কর্তৃত্বের আসন)৷ সেখান থেকে সমগ্র বিশ্ব জাহানের নব নব সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে ও ক্রমাগত শক্তির বিচরণ ঘটেছে , সেই সাথে সৃষ্টি জগতের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাও অব্যাহত রয়েছে৷আবার এও সম্ভব হতে পারে যে, আরশ অর্থ শাসন কর্তৃত্ব এবং আরশের ওপর সমাসীন হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ এ বিশ্ব -জাহান সৃষ্টি করার পর এর শাসন দণ্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন৷ মোটকথা আরশের ওপর সমাসীন হওয়ার বিস্তারিত অর্থ যাই হোক না কেন, মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ যে, এ বিশ্ব-জগতের নিছক স্রষ্টাই নন বরং এর পরিচালক ও ব্যবস্থাপকও একথা ভালভাবে হৃদয়ংগম করানোই কুরআনে এর উল্লেখের আসল উদ্দেশ্য৷ তিনি এ দুনিয়াকে অস্তিত্বশীল করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি৷ বরং কার্যত তিনিই সারা বিশ্ব-জাহানের ছোট বড় প্রত্যেকটি বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব করেছেন৷ পরিচালনা ও শাসন কৃর্তৃত্বের যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ৷ প্রতিটি বস্তু তাঁর নির্দেশের অনুগত৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণাও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে৷ প্রতিটি বন্তু ও প্রানীর ভাগ্যই চিরন্তরভাবে তাঁর নির্দেশের সাথে যুক্ত৷ যে মৌলিক বিভ্রান্তিটির কারণে মানুষ কখনো শিরকের গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, আবার কখনো নিজেকে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন ঘোষণা করার মতো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কুরআন এভাবে তার মূলোৎপাটন করতে চায়৷বিশ্ব-জাহানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা থেকে আল্লাহকে কার্যত সম্পর্কহীন মনে করার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় দুটি৷ মানুষ নিজের ভাগ্য কে অন্যের হাতে বন্দি মনে করবে এবং তার সামনে মাথা নত করে দেবে অথবা নিজেকেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করবে এবং নিজেকে সর্বময় কর্তৃত্বশীল স্বাধীন সত্তা মনে করে কাজ করে যেতে থাকবে৷
"আরশের উপর সমাসীন হলেন" ব্যাকটির মাধ্যমে সংক্ষেপে যে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছিল এখানে তারই অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ অর্থাৎ নিছক স্রষ্টাই নন, তিনি হুকুমকর্তা এবং শাসকও ৷ তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বে সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামত চলার জন্যে স্বাধীবভাবে ছেড়ে দেননি৷ বরং কার্যত সমগ্র বিশ্ব জগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে৷ দিন রাত্রির আবর্তন আপনা আপনিই হচ্ছে না৷ বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে ৷ তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন আর যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন৷ সূর্য, চন্দ্র , তারকা এরা কেউ নিজস্ব কোন শক্তির অধিকারী নয়৷ বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন৷ এরা একান্ত অনুগত দাসের মত সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন
৷
বরকতের আসল অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, উন্নতি, বিকাশ ৷ এই সংগে এ শব্দটির মধ্যে একদিকে উচ্চতা ও মহত্বের ভাবধারা নিহিত রয়েছে এবং অন্যদিকে রয়েছে স্থীতিশীলতা ও অবিচলতার ভাবধারাও৷ আবার মংগল ও কল্যাণের ভাবধারাও নিশ্চিতভাবে এসব অর্থের অন্তরভুক্ত রয়েছে৷ কাজেই আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী হবার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তাঁর মংগল ও কল্যাণের কোন সীমা নেই৷ তাঁর সত্তা থেকে সীমাহীন কল্যাণ চতুর্দিকে বিস্তৃত হচ্ছে এবং তিনি অতি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ এক সত্তা৷ তাঁর মহত্বের কোন শেষ নেই৷ আর তাঁর এ কল্যাণ ,মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব চিরস্থায়ী , ও অনন্তকালীন -সাময়িক নয় ৷ এর ক্ষয়ও নেই৷ পতনও নেই৷ (আল -ফুরকান, টীকা ১-১৯দ্রষ্টব্য)
বাকারা ১৮৬) আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও , আমি তাদের কাছেই আছি ৷ যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত ১৮৮ একথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে ৷ ১৮৯
১৮৮ . অর্থা যদিও তোমরা আমাকে দেখতে পাও না এবং ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভবও করতে পারো না তবুও আমাকে তোমাদের থেকে দূরে মনে করো না৷ আমি আমার প্রত্যেক বান্দার প্রতি নিকটেই অবস্থান করছি৷ যখনই তারা চায় আমার কাছে আর্জি পেশ করতে পারে৷ এমনকি মনে মনে আমার কাছে তারা যা কিছু আবেদন করে তাও আমি শুনতে পাই৷ আর কেবল শুনতেই পাই না বরং সে সম্পর্কে নিজের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করি৷ নিজেদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে যে সমস্ত অলীক, কাল্পনিক ও অক্ষম সত্তাদেরকে তোমরা উপাস্য ও প্রভু গণ্য করেছো তাদের কাছে তোমাদের নিজেদের দৌড়িয়ে যেতে হয় এবং তারপরও তারা তোমাদের কোন আবেদন নিবেদন শুনতে পায় না৷ তোমাদের আবেদনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতাও তাদের নেই৷ অন্যদিকে আমি হচ্ছি এই বিশাল বিস্তৃত বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি৷ সমস্ত সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আমারই হাতে কেন্দ্রীভূত৷ তোমাদের এতো কাছে আমি অবস্থান করি যে, কোন প্রকার মাধ্যমে ও সুপারিশ ছাড়াই তোমরা নিজেরাই সরাসরি সর্বত্র ও সবসময় আমার কাছে নিজেদের আবেদন নিবেদন পেশ করতে পারো৷ কাজেই মুর্খতার বেড়াজাল তোমরা ছিঁড়ে ফেলো৷ আমি তোমাদের যে আহবান জানাচ্ছি সে আহবানে সাড়া দাও৷ আমার আদর্শকে আঁকড়ে ধরো৷ আমার দিকে ফিরে এসো৷ আমার ওপর নির্ভর করো৷ আমার বন্দেগী ও আনুগত্য করো৷
১৬) আমি ১৯ মানুষকে সৃষ্টি করেছি আর তাদের মনে যেসব কুমন্ত্রণা উদিত হয় তা আমি জানি৷ আমি তার ঘাড়ের রগের চেয়েও তার বেশী কাছে আছি৷ ২০
২০. অর্থাৎ আমার ক্ষমতা ও জ্ঞান ভিতর ও বাহির থেকে এমনভাবে মানুষকে পরিবেষ্টিত করে আছে যে, আমার ক্ষমতাও জ্ঞান তার যতটা নিকটে ততটা নিকটে তার ঘাড়ের শিরাও নয় ৷ তার কথা শোনার জন্য আমাকে কোথাও থেকে আসতে হয় না ৷ তার মনের মধ্যে উদিত কল্পনাসমূহ পর্যন্ত আমি সরাসরি জানি ৷ অনুরূপভাবে তাকে যদি কোন সময় পাকড়াও করতে হয় তখনও আমাকে কোথাও থেকে এসে তাকে পাকড়াও করতে হয়না ৷ সে যেখানেই থাকুক, সর্বদা আমার আয়ত্বাধীনেই আছে যখন ইচ্ছা আমি তাকে বন্দী করবো ৷
ওয়াক্বিয়া ৮৫। অথচ আমি তোমাদের চেয়েও তার [ মুমূর্ষ ব্যক্তির ] অধিক নিকটে থাকি, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না,
দেখুন তাফসীর মারেফুল কুরআন p/1331
বাকারা ১১৫) পূর্ব ও পশ্চিম সব আল্লাহর ৷ তোমরা যেদিকে মুখ ফিরাবে সেদিকেই আল্লাহর চেহারা বিরাজমান ৷১১৫ আল্লাহ বড়ই ব্যাপকতার অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জ্ঞাত ৷১১৬
১১৫. অর্থাৎ আল্লাহ পূর্বেরও নয়, পশ্চিমেরও নয় ৷ তিনি সকল দিকের ও সকল স্থানের মালিক ৷ কিন্তু নিজে কোন স্থানের পরিসরে সীমাবদ্ধ নেই ৷ কাজেই তাঁর ইবাদাতের জন্য কোন দিক বা স্থান নিদিষ্ট করার অর্থ এ নয় যে , আল্লাহ সেদিকে বা সে স্থানে থাকেন ৷ কাজেই ইতিপূর্বে তোমরা ওখানে বা ঐ দিকে ফিরে ইবাদাত করতে আর এখন সেই জায়গা বা দিক পরিবর্তন করলে কেন –একথা নিয়ে ঝগড়া বা বিতর্ক করার কোন অবকাশ নেই ৷
হাদীদ ৫) তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সাথে আছেন৷ ৬ তোমরা যা করছো আল্লাহ তা দেখছেন৷ আসমান ও যমীনের নিরংকুশ সার্বভৌম মালিকানা একমাত্র তাঁরই৷ সব ব্যাপারের ফায়সালার জন্য তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হয়৷
৬. অর্থাৎ তোমরা কোন জায়গায়ই তাঁর জ্ঞান, তাঁর অসীম ক্ষমতা, তাঁর শাসন কর্তৃত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাপনার আওতা বহির্ভূত নও৷ মাটিতে, বায়ুতে, পানিতে, অথবা কোন নিভৃত কোণে যেখানেই তোমরা থাক না কেন, সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ জানেন, তোমরা কোথায় আছো৷ সেখানে তোমাদের বেঁচে থাকাটাই একথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ঐ স্থানেও তোমাদের জীবন ধারণের উপকরণ সরবরাহ করেছেন৷ তোমাদের হৃদপিণ্ডে যে স্পন্দন উঠেছে, তোমাদের ফূসফূস যে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করেছে, তোমাদের শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টিশক্তি যে কাজ করছে এসব কিছুরই কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় তোমাদের দেহের সব যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করছে৷ কোন সময় যদি তোমাদের মৃত্যু আসে তাহলে এ কারণে আসে যে, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তোমাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থাপনার পরিসমপ্তি ঘটিয়ে তোমাদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে৷