পীর-মাশায়েখ নামধারী এক শ্রেণীর ধর্মীয় আলেম সম্প্রদায় আল্লাহর নাজিলকৃত যে সকল আইন-বিধানকে বাতিল করেছেন তার কিছু উদাহরণ দিবেন কি?


পীর-মাশায়েখ নামধারী এক শ্রেণীর ধর্মীয় আলেম সম্প্রদায় আল্লাহর নাজিলকৃত যে সকল আইন-বিধানকে বাতিল করেছেন তার কিছু উদাহরণ দিবেন কি?

উত্তর: হ্যা! অবশ্যই। পীর-মাশায়েখ নামধারী এক শ্রেণীর আলেমগন আল্লাহর নাজিলকৃত যেসকল আইন-বিধানকে বাতিল করেছেন তার কিছু অংশ সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে পেশ করা হলো। বিস্তারিত আকারে দলীল প্রমাণসহ পরবর্তিতে প্রকাশ করা হবে ইনশাআল্লাহ ।

শরিয়াহ মানার প্রয়োজন: কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক সহীহ আক্বিদাহ হলো আল্লাহ (সুব:) কর্তৃক প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ (সা:) কর্তৃক প্রদর্শিত শরিয়ার আইন-বিধান কঠোরভাবে মান্য করা জরুরী। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ (সুব:) বলেন:

{شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ} [الشورى : 13]

অর্থ: “তিনি তোমাদের জন্য দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; (তা হচ্ছে ঐই জীবন ব্যবস্থা) যার ব্যাপারে তিনি নূহ (আ:) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আমি (আল্লাহ) তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দ্বীন কায়েম করো এবং এই ব্যাপারে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সুরা শু’রা ২৬:১৩)

এই আয়াত দ্বারা বুঝা গেল, আল্লাহ (সুব:) জীবন ব্যাবস্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এবং ঐ জীবন ব্যাবস্থাই কায়েম করা আদেশ করেছেন। সুতরাং মুসলিমের কর্তব্য হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত জীবন ব্যাবস্থাই পালন করবে এবং কায়েম করবে। অন্য কারো হুকুম যদি আল্লাহর হুকুমের বিরোধি হয় তাহলে তা প্রত্যাখান করবে।

কিন্তু পীর-মাশায়েখগণ বলেন: পীর যদি হুকুম করেন তা মানতে হবে যদিও আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তের প্রকাশ্য বিরোধী হয়। যেমন চরমোনাই পীর বলেন:
بمی سجادہ رنگن کن گرت پیر مغاں گوید+کہ سالک بےخبر نہ بود زراہ ورسم منزل
অর্থ: “কামেল পীরের আদেশ পাইলে নাপাক শারাব দ্বারাও জায়নামাজ রঙ্গিন করিয়া তাহাতে নামাজ পড়। অর্থাৎ শরীয়তের কামেল পীর সাহেব যদি এমন কোন হুকুম দেন, যাহা প্রকাশ্যে শরীয়তের খেলাফ হয়, তবুও তুমি তাহা নিরাপত্তিতে আদায় করবে। কেননা, তিনি রাস্তা সব তৈরী করিয়াছেন। তিনি তাহার উঁচু-নিচু অর্থাৎ ভালমন্দ সব চিনেন, কম বুঝের দরুন জাহেরিভাবে যদিও তুমি উহা শরীয়তের খেলাফ দেখ কিন্তু মূলে খেলাফ নহে।” (‘আশেক মাশুক’ মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক রচিত ৩৫ নং পৃষ্ঠায়।)

অথচ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সা:) এর হুকুমের বিরূদ্ধে কারো হুকুম মানার কোন সুযোগ নেই।
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:
عَنْ أُمِّ حُصَيْنٍ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيه وسَلَّم لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ في مَعْصِيَةِ الخَالِقِ
অর্থ: “উম্মে হুসাইন (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন: স্রষ্টাকে অমান্য করে সৃষ্টিজগতের কারো আনুগত্য চলবে না”। (জামেউল আহাদীস: হা: ১৩৪০৫, মুয়াত্তা: হা: ১০, মু’জামূল কাবীর: হা: ৩৮১, মুসনাদে শিহাব: হা: ৮৭৩ আবি শাইবা: হা: ৩৩৭১৭, কানযুল উম্মাল: হা: ১৪৮৭৫।)

এছাড়া নিম্নের হাদীসটিতে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করা হয়েছে:
عَنْ عَلِىٍّ قَالَ بَعَثَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- سَرِيَّةً وَاسْتَعْمَلَ عَلَيْهِمْ رَجُلاً مِنَ الأَنْصَارِ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يَسْمَعُوا لَهُ وَيُطِيعُوا فَأَغْضَبُوهُ فِى شَىْءٍ فَقَالَ اجْمَعُوا لِى حَطَبًا. فَجَمَعُوا لَهُ ثُمَّ قَالَ أَوْقِدُوا نَارًا. فَأَوْقَدُوا ثُمَّ قَالَ أَلَمْ يَأْمُرْكُمْ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنْ تَسْمَعُوا لِى وَتُطِيعُوا قَالُوا بَلَى. قَالَ فَادْخُلُوهَا. قَالَ فَنَظَرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ فَقَالُوا إِنَّمَا فَرَرْنَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مِنَ النَّارِ. فَكَانُوا كَذَلِكَ وَسَكَنَ غَضَبُهُ وَطُفِئَتِ النَّارُ فَلَمَّا رَجَعُوا ذَكَرُوا ذَلِكَ لِلنَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ ্র لَوْ دَخَلُوهَا مَا خَرَجُوا مِنْهَا إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ
অর্থ: “আলী (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) একটি সেনাদল যুদ্ধাভিযানে প্রেরণ করলেন। এক আনসারী ব্যক্তিকে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। এবং সাহাবীদেরকে তার কথা শুনা ও মানার জন্য নির্দেশ দিলেন। অতপর তাদের কোন আচরণে সেনাপতি রাগ করলেন। তিনি সকলকে লাকড়ি জমা করতে বললেন। সকলে লাকড়ি জমা করলো এরপর আগুন জ্বালাতে বললেন। সকলে আগুন জ্বালালো। তারপর সেনাপতি বললো রাসূলুল্লাহ (সা:) কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করার এবং আমার কথা শুনা ও মানার নির্দেশ দেন নাই? সকলেই বললো, হ্যা। তিনি বললেন, তাহলে তোমরা সকলেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়। সাহাবীগণ একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। এবং বললেন, আমরাতো আগুন থেকে বাঁচার জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে এসেছি। এ অবস্থায় কিছুক্ষন পর তার রাগ ঠান্ডা হলো এবং আগুনও নিভে গেল। যখন সাহাবারা মদীনায় প্রত্যাবর্তণ করলেন তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে উপস্থাপন করা হলো। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন ‘তারা যদি আমীরের কথা মতো আগুনে ঝাঁপ দিতো তাহলে তারা আর কখনোই তা থেকে বের হতে পারতো না। প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য কেবল ন্যায় এবং সৎ কাজেই।”(সহীহ মুসলিম হা:নং: ৪৮৭২, সহীহ বুখারী হা: নং: ৪৩৪০, সহীহ মুসলিম বাংলা; ইসলামিক ফাউন্ডেশন কতৃক তরজমা; হা: নং: ৪৬১৫।)

এ হাদীস থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, শরিয়তের বিরূদ্ধে কারো হুকুমের আনুগত্য করা যাবে না। অথচ পীর সাহেবদের কাছে কুরআন ও হাদীসে বর্নিত এসকল বিষয়ের কোনই গুরুত্ব নেই। এমনকি তাদের ধর্ম ও মাযহাব ভিন্ন বলে তারা দাবী করে থাকে। যেমন: ‘ভেদে মারেফাত বা ইয়াদে খোদা’ এর ৭২ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে
عاشقاں را ملت و مذہب جداست+عاشقاں را ملت و مذہب خداست
অর্থ: “মাওলানা রুমি ফরমাইয়াছেন: প্রেমিক লোকদের জন্য মিল্লাত ও মাজহাব ভিন্ন। তাহাদের মিল্লাত ও মাজহাব শুধু মা’বুদ কেন্দ্রিক।”

উল্লেখ্য যে, সকল মুসলিমদের দ্বীনই আল্লাহ কেন্দ্রিক এবং আল্লাহর কর্তৃক নির্ধারিত। এখানে গোপন কোন বিষয় নেই বরং দ্বীনে ইসলাম স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার একটি ধর্ম। তাহলে পীর সাহেবরা খোদা কেন্দ্রিক কোন ধর্মের কথা বলতে চাচ্ছেন যা অন্যদের ধর্ম থেকে আলাদা? তাহলে দ্বীনে ইসলামের মধ্যে এমনো কোন বিষয় আছে কি যা রাসূলুল্লাহ (সা:) উম্মতের সকলের সামনে প্রকাশ করেননি? এটাতো শীয়াদের বক্তব্য । পীর সাহেবরাও কি শীয়াদের মতাদর্শকে সমর্থণ করছে?

তাছাড়া ছয় লতিফা সম্পর্কে চরমোনাইয়ের পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ইসহাক সাহেব বলেন, ‘ছয় লতিফার কথা কুরআনে পাক ও হাদীস শরীফে নাই, তবে আল্লাহ পাকের ওলীগণ আল্লাহ পাককে পাইবার জন্য একটা রাস্তা হিসাবে ইহা বাহির করিয়াছেন। যদি লতীফার ছবক আদায় করিতে চান, তবে একজন উপযুক্ত পীরের দরবারে থাকিতে হইবে। (‘ভেদে মা’রেফাত বা ইয়াদে খোদা’ পৃষ্ঠা নং: ৫০।)

তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহ (সুব:) কে পাইবার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) কি কোন রাস্তা বলে দেননি? যদি বলে দিয়ে থাকেন তাহলে নতুন করে রাস্তা বানানোর দরকার পরলো কি? তাছাড়া আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তা উম্মতের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া সাধারণ কোন শাখাগত বিষয় নয় যে, বিষয়টি উম্মতের ইজতিহাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হবে।

পীরের কাছে মুরীদ হওয়া ফরজ:

কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ফরজ বিধান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ (সুব:)। ইরশাদ হচ্ছে:
{ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ} [الأنعام : ৫৭]
অর্থ: “বিধান দিবার অধিকার আল্লাহরই।”(সূরা ইউসুফ ১২:৪০।)
আল্লাহ (সুব:) আরও ইরশাদ করেছেনঃ
{ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ } [الأعراف : ৫৪]
অর্থ: “জেনে রেখো সৃষ্টি এবং বিধান তাঁরই।”(সূরা আরাফ ৭:৫৪।)

পীর-সূফীদের আক্বীদাহ হলো পীরের কাছে মুরীদ হওয়া ফরজ। যেমন চরমোনইয়ের পীর সাহেব ‘মাওয়ায়েজে এসহাকিয়া’ নামক কিতাবে বলেন: ‘পীরের কাছে মুরীদ হওয়া ফরজ’। তিনি আরও বলেন, ‘যদি কারো দুইজন পীর হয় তবে দুই পীর তোমার দুই ডানা ধরে বেহেশতে নিয়ে যাবেন। কোনই ক্ষতি নাই।’(‘মাওয়ায়েজে এছহাকিয়া’ সৈয়দ মা:মো: মোমতাজুল করীম রচিত: পৃষ্ঠা নং: ৫৫-৫৬ )
এছাড়া তিনি আরও বলেন: ‘যার কোন পীর নাই তার পীর শয়তান।’ এজন্য তারা একটি আরবী বাক্য তৈরী করেছে যাতে সাধারণ মানুষের আরবী দেখে এটাকে কুরআন-হাদীস মনে করে বিনা আপত্তিতে মেনে নেয়। সে বাক্যটি হলো:
مَنْ لَيْسَ لَهٌ شَيْخٌ فَشَيْخُه شَيْطَانٌ
অর্থ: “যার কোন পীর নাই তার পীর শয়তান।”(‘ভেদে মারেফাত বা ইয়াদে খোদা’ মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক রচিত: পৃষ্ঠা নং: ২৩।)

এ আরবী বাক্য শুনে অনেকেই এটিকে হাদীস বলে বিশ্বাস করে অথচ এটি কোন হাদীস নয় পীর-সূফীদের মনগড়া একটি বাক্য মাত্র। পীরদের যতগুলো সিলসিলা রয়েছে প্রায় সকলের আক্বিদাই এরকম । যেমন চরমোনাই পীরদের আক্বিদাহ তাদের বই থেকে উপরে উল্লেখ করা হলো।

এনায়েতপুরী পীর ও তার অনুসারীদের আক্বীদাহ-বিশ্বাসও একই রকম। তাদের রচিত কিতাব ‘শরীয়তের আলো’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে, ‘পীর ধরা সবার জন্য ফরজ’।( ‘শরীয়তের আলো’ খাজা বাবা এনায়েতপুরী সাহেবের অনুমোদন ক্রমে মাওলানা মো: মকিম উদ্দিন প্রণীত। প্রকাশক পীরজাদা মৌ: খাজা কামার উদ্দিন (নুহ মিয়া)।)

সুরেশ্বরী পীর লিখেছেন: ‘পীরের নিকট দীক্ষিত না হইলে কোন বন্দেগী কবূল হয় না।’(নুরে হক গঞ্জে নুর, পৃষ্ঠা নং ২৫, সুরেশ্বর দরবার এর পক্ষে সৈয়দ শাহ নূরে মঞ্জুর মোর্শেদ (মাহবুবে খোদা) ও ভ্রাতাগণ কর্তৃক প্রকাশিত, একদশ সংস্করণ ১৯৯৮।)

ভায়া মাধ্যম:

আল্লাহ (সুব:) পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন মানুষ যত বড় পাপ ও গুনাহ করুক না কেন যদি তারা খাঁটি মনে আল্লাহর কাছে তওবা করেন তবে আল্লাহ (সুব:) অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দিবেন। এজন্য কোন ভায়া মাধ্যমের প্রয়োজন নাই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ (সুব:) ইরশাদ করেন:
{وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا} [النساء : ১১০]
অর্থ: “আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি যুলম করবে তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সুরা নিসা: ১১০)

এখানে সরাসরি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোন প্রকারের ভায়া মাধ্যমের কথা নেই।
আল্লাহ (সুব:) আরও ইরশাদ করেন:
{ قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ } [الزمر : ৫৩]
অর্থ: “বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(সুরা যুমার ৩৯:৫৩।)

কিন্তু পীর-মাশায়েখগণ বলেন, বান্দা অসংখ্য গুনাহ করলে পীরের মাধ্যম ছাড়া আল্লাহ (সুব:) মাফ করতে চান না। যেমন: চরমোনাইয়ের পীর বলেন: ‘বান্দা অসংখ্য গুনাহ করার ফলে আল্লাহ পাক তাহাকে কবুল করিতে চান না। পীর সাহেব আল্লাহ পাকের দরবারে অনুনয় বিনয় করিয়া ঐ বান্দার জন্য দোয়া করিবেন, যাহাতে তিনি কবুল করিয়া নেন। ঐ দোয়ার বরকতে আল্লাহ পাক তাহাকে কবুল করিয়া নেন।’ (‘ভেদে মা’রেফাত বা ইয়াদে খোদা’ মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এসহাক রচিত, পৃষ্ঠা নং ৩৪।)

তাদের এই বক্তব্য স্পষ্ট কুরআনের আয়াতের পরিপন্থি। ছোট বেলায় একটি কৌতুক শুনেছিলাম এক লোক শয়তানকে জিজ্ঞাসা করেছিলো; ওহে শয়তান! এক লোক সারা জীবন অন্যায় করেছে, পাপ করেছে এখন সে বৃদ্ধ বয়সে এসে তওবা করেছে আর কখনো গুনাহ করবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তুমি তাকে কিভাবে গোমরাহ করো? শয়তান হেসে বললো, এতো খুবই সহজ বিষয়। আমি তাকে বুঝাই তুমি সারা জীবন অন্যায় করেছ, পাপ করেছ। পাপ করতে করতে সীমালঙ্ঘন করেছ। তোমাকে আল্লাহ (সুব:) এইভাবে ক্ষমা করবেন না বরং তোমাকে একজন পীর ধরতে হবে। ঐ পীর যদি তোমার জন্য অনুনয়-বিনয় করিয়া আল্লাহর কাছে তোমার জন্য ক্ষমা চান তাহলেই কেবলমাত্র তুমি ক্ষমা পাইতে পার। এভাবে বুঝাইয়া-সমঝাইয়া তাকে একজন পীর ধরাইয়া দেই। এরপরে আমার বাকী কাজ ঐ পীর সাহেবই আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। এটি একটি কৌতুক। এর কোন বাস্তবতা জানা ছিল না। কিন্তু চরমোনইয়ের পীর সাহেবের ‘ভেদে মারেফাত বা ইয়াদে খোদা’ নামক বই পড়ার পরে শয়তানের এই অভিনব কৌশলের বাস্তব দলীল পাওয়া গেল।

আল্লাহর আন্দাজ নাই:

মুসলিম জাতির ঈমান-আক্বিদার একটি মূল ভিত্তি হলো যে, আল্লাহ (সুব:) সকল কাজ সুপরিকল্পিত ও সুপরিমিতভাবে করেন। আল্লাহ (সুব:) পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
{إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ} [القمر : ৪৯]
অর্থ: “নিশ্চয় আমি সব কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাণ অনুযায়ী (কোন ধরণের অসঙ্গতী ছাড়া)।” (সুরা ক্বামার: ৪৯)
এছাড়াও আল্লাহ (সুব:) পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
{ لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ} [الأنبياء : ২৩]
অর্থ: “তিনি যা করেন সে ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে।” (সুরা আম্বিয়া: ২৩)

কিন্তু চরমোনাইয়ের পীর সাহেব ‘ভেদে মারেফাত নামক বইতে মছনবীয়ে রূমীর বরাত দিয়ে শামসূ তাবরিজীর নকল শিরোনামে লিখেন: “বাদশাহ কুতুব সাহেবকে দরবারে হাজির করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হুজুর, আপনি কি বলিয়া বৃদ্ধের নাতিকে জেন্দা করিয়াছেন? তিনি বলিলেন যে আমি বলিয়াছি, হে ছেলে! আমার আদেশে জীবিত হইয়া যাও। বাদশাহ বলিলেন, আফসোস যদি আল্লাহর আদেশে জেন্দা হইতে বলিতেন। কুতুব সাহেব উত্তর করিলেন মাবুদের কাছে আবার কি জিজ্ঞাসা করিব তাহার আন্দাজ নাই। এই বৃদ্ধার একটি মাত্র পুত্র ছিল তাহাও নিয়াছে। বাকি ছিল এই নাতিটি যে গাভী পালন করিয়া কোনরূপ জিন্দেগী গুজরান করিত এখন এটিও নিয়া গেল। তাই আমি আলস্নাহ পাকের দরবার থেকে জোড়পূর্বক রূহ নিয়া আসিয়াছি।” (ভেদের মারেফাত বা ইয়াদে খোদা ১৫ পৃষ্ঠা।)
এই ধরণের ঘটনা বর্ণনা করা এবং এর উপরে বিশ্বাস রাখা যে কুরআন বিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১২৬ তরীকা:

আল্লাহ (সুব:) কর্তৃক নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী মানব জাতির মুক্তির পথ কেবল মাত্র একটি। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে:
{وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ} [الأنعام : ১৫৩]
অর্থ: “আর এটিই আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।”(সুরা আনআ’ম ৬:১৫৩।)
এই আয়াতে আল্লাহ (সুব:) একটি তরীকাকেই অনুসরণ করতে বলেছেন। আল্লাহ (সুব:) বলেন:
{وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ وَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ } [النحل : ৯]
অর্থ: “আর সঠিক পথ বাতলে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব, এবং পথের মধ্যে কিছু আছে বক্র। আর তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে হিদায়াত করতেন।”(সুরা নহল ১৬:৯।)

রাসূলুল্লাহ (সা:) থেকে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ সর্ম্পকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطًّا ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوطًا عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ هَذِهِ سُبُلٌ قَالَ يَزِيدُ مُتَفَرِّقَةٌ عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ ثُمَّ قَرَأَ { إِنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ }
অর্থ: “আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদেরকে (সিরাতে মুস্তাকিম বুঝানোর জন্য) প্রথমে একটি সোজা দাগ দিলেন। আর বললেন এটা হলো আল্লাহর রাস্তা । অতপর ডানে বামে অনেকগুলো দাগ দিলেন আর বললেন এই রাস্তাগুলো শয়তানের রাস্তা । এ রাস্তাগুলোর প্রতিটি রাস্তার মুখে মুখে একেকটা শয়তান বসে আছে যারা এ রাস্তার দিকে মানুষদেরকে আহবান করে। অতপর রাসূলুল্লাহ (সা:) নিজের কথার প্রমাণে উপরে উল্লেখিত প্রথম আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন।” (মুসনাদে আহমদ ৪১৪২; নাসায়ী ১১১৭৫; মেশকাত ১৬৬।)

কিন্তু পীর-মাশায়েখ গণের তরীকা অনেক । যেমন: চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মোহাম্মদ এসহাক সাহেব তার প্রায় সকল বইতেই উল্লেখ করেছেন যে, “আমার প্রিয় বন্ধুগণ! জানিয়া রাখিবেন, দোযখের আযাবের পথ বন্ধ করিয়া বেহেশতে যাইবার জন্য কেতাবে ১২৬ তরিক বয়ান করিয়াছেন। তন্মধ্যে চিশতিয়া ছাবেরিয়া তরিকা একেবারে শর্টকাট এই তরিকার প্রথম ছবকখানা লিখিয়া এজাজত দিলাম।” (‘আশেক মা’শুক’ সৈয়দ মাওলানা এসহাক রচিত পৃষ্ঠা নং ১১২, একই লেখকের কিতাব ‘ভেদে মারেফাত ইয়াদে খোদা’ পৃষ্ঠা নং ৬।)

আবার সূফীদের কোন কোন বইতে বলা হয়েছে, ‘তরীকার সংখ্যা অগনিত তবে বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় তিন শতাধিক তরীকা বিদ্যমান রয়েছে’।( ‘সূফী দর্শণ’ ড: ফকির আবদুর রশিদ রচিত, পৃষ্ঠা নং: ১৬৭।)

অথচ রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى
অর্থ: আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন; আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে যে অস্বীকার করল (সে ব্যতিত)। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! অস্বীকার করল কে? রাসূল (সাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে আমার আনুগত্য করল না সেই অস্বীকার করল (ফলে সে জাহান্নামে যাবে)। ( সহীহ বুখারী।)

এই হাদীস দ্বারা বুঝা গেল জান্নাতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা রাসূল (সা:) এর তরিকায় চলা। চরমোনাইয়ের পীরদের বাতলানো চিশতিয়া ছাবেরিয়া তরিকা নয়। এ সমস্ত তরিকার বয়ান পবিত্র কুরআনে ও হাদীসে নাই। তাহলে ১২৬ তরিকা ওনারা কোন কিতাবে পেলেন?

আল্লাহর সাথে মিশে যাওয়া:

ইসলামে তাওহীদের গুরুত্ব অপরিসীম। যার অর্থ হলো: এক ইলাহের সার্বভৌমত্ব ও এক ইলাহের বিধান মেনে নেওয়া। উলুহিয়্যাত, রুবুবিয়্যাত ও আসমা ওয়াস সীফাত সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ (সুব) এর একাত্ব বজায় রাখা। কিন্তু পীর-সূফীদের পরিভাষায় তাওহীদ মানে হলো ‘আল্লাহর সাথে একাকার হয়ে যাওয়া’। অর্থাৎ বান্দা ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যেখন বান্দা ও আল্লাহর মাঝে কোন পার্থক্য থাকে না । চিনি যেভাবে পানির সঙ্গে মিশে যায় সেভাবে আল্লাহওয়ালাগণ আল্লাহর সঙ্গে মিশে যান । এরা তাদের এই মতের সপক্ষে নিম্নের হাদীসটিকে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করে থাকে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ
অর্থ: “আবূ হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সাথে শত্রুতা রাখবে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি । আমার বান্দা আমি তার উপর যা ফরয করেছি তার চেয়ে আমার কাছে বেশী প্রিয় কোন ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জণ করতে পারে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জণ করতে থাকে, এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অব্যশই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যে কোন কাজ করতে চাইলে এটাতে কোন রকম দ্বিধা সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা সংকোচ মু’মিন বান্দার প্রাণ হরণে করি। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্ট অপসন্দ করি।” (সহীহ বুখারী ৬৫০২)

এই হাদীস দ্বারা দলীল দিয়েই ভারত বর্ষের প্রসিদ্ধ সুফীবাদী তাফসীর ‘তাফসীরে মাযহারী’ তে বলা হয়েছে:
اِنَّ اللَّه تَعَالَي يَسْتَوْدِعُ فِيْ قُلُوْبِ بَعْضِهِمْ مَحَبَةً ذَاتِيَّةً مِنْهُ تَعَالَيْ مُوْجِبَةً لِلمَعِيِّةِ الذَاتِيِّةِ
অর্থ: “আল্লাহ (সুব:) কোন কোন মানুষের অন্তরের মধ্যে তার জাতি (সত্ত্বাগত) মুহাব্বত তৈরী করে দেন ফলে সে সত্ত্বাগতভাবে আল্লাহর সাথে মিশে যায়।”(‘তাফসীরে মাযহারী’ প্রথম খন্ড ৫০ পৃষ্ঠায় إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ আয়াতের তাফসীরে দ্রষ্টব্য।)

সূফীদের সকল তরীকার লোকদের কাছেই এ আক্বীদাহ ও বিশ্বাস গ্রহণযোগ্য। এ আক্বীদার প্রথম প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ‘মানসূর হাল্লাজ’ নামক এক ভন্ড সূফীকে বলা হয়ে থাকে। তিনিই সর্বপ্রথম এ আক্বীদাহ প্রকাশ করেন। এবং তিনি اَنَا الحَقُّ ‘আমিই আল্লাহ’ বলে যিকির করা শুরু করেন। তাছাড়া তিনি আরও কিছু কবিতা আবৃত্তি করেন যা থেকে তার এই আক্বীদাহর চুড়ান্ত ব্যাখ্যা জানা যায়। কবিতাগুলো এই:
أَنَا الْحَقُّ وَالْحَقُّ لِلْحَقِّ # لَابِسٌ ذَاتَهُ فَمَا ثَمَّ فَرْقٌ
অর্থ: আমিই হক্ব (আল্লাহ)। হক্ব হক্বের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
أَنَا أَنْتَ بِلَا شَكِّ # فَسُبْحَانَكَ سُبْحَانِيْ
فَتَوْحِيْدُكَ تَوْحِيْدِيْ # وَعِصْيَانُكَ عِصْيَانِيْ
অর্থ: নিঃসন্দেহে আমিই তুমি, তোমার পবিত্রতা সেতো আমারই পবিত্রতা, তোমার তাওহীদ সেতো আমারই তাওহীদ, তোমার অবাধ্যতা সেতো আমারই অবাধ্যতা।
أَنَا مَنْ أَهْوِىْ وَمَنْ أَهْوِى أَنَا # نَحْنُ رُوْحَانِ حَلَلْنَا بَدَنًا
অর্থ: “আমি যাকে চাই সেতো আমিই। আমরা দু’টো রুহ (প্রাণ) একই দেহে প্রবেশ করেছি।”
مَزَجَتْ رُوْحُكَ فِيْ رُوْحِيْ كَمَا … تَمْزَجُ الْخَمْرَةُ فِي الْمَاءِ الزَّلَالِ
فَإِذَا مَسَّكَ شَيْءٌ مَسَّنِيْ … فَإِذَا أَنْتَ أَنَا فِيْ كُلِّ حَالٍ
অর্থ: তোমার রুহটা আমার রুহের সঙ্গে মিশে গেছে যেমনিভাবে শরাব স্বচ্ছ পানির সঙ্গে মিশে যায়। তাই তোমাকে কোন বিপদ-আপদ স্পর্শ করলে আমাকেই স্পর্শ করে। তুমি আর আমি সর্বাবস্থায় একই।( মুহাব্বাতুর রাসূল বাইনাল ইত্তিবায়ে ওয়াল ইবতিদায়ে ১ম খন্ড ২১১পৃষ্ঠা।)

এভাবে ‘মানসূর হাল্লাজ’ এই জঘন্য শিরকি আক্বিদার গোড়াপত্তণ করেন। পরবর্তীতে সূফীদের শায়খে আকবার ‘মহিউদ্দীন ইবনে আরাবী’ এই আক্বীদাকে আরও সম্প্রসারণ করে ‘ওয়াহদাতুল অজুদ’ এর আক্বীদাহ মুসলিম জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেন। যার সারকথা হলো, ‘বান্দা এবং আল্লাহর অস্তিত্ব এক।’

বর্তমান পীর-সূফীদেরও একই আক্বীদাহ। যেমন: চরমোনাইয়ের পীর সাহেব বলেন: ‘মানছুর হাল্লাজ যখন আল্লাহ পাকের এশকের জোশে দেওয়ানা হইতেন, তখন তিনি এই শের পড়িতেন:
من تو شدم تو من شودی من تن شدم تو جاںشدی
بعدازاں کسی نگوید کہ من دیگر م تو دیگری
ওগো আমার মা’শুক মাওলা! আপনি আপন কুদরাতী নজরে আমার দিকে চাহিয়া দেখুন। আমি এখন আমি নাই। আমি আপনি হইয়াছি আর আপনি আমি হইয়াছেন। আমি হইয়াছি তন্‌, আপনি হইয়াছেন জান। আমি শরীর আপনি প্রাণ। এরপর আর কেহ বলিতে পারে না যে, আমি একজন আপনি আর একজন। বরং আমি ও আপনি এক হইয়া গিয়াছি, অর্থাৎ আমি আপনার জামালের খুশীর মধ্যে ডুবিয়া গিয়াছি, আমার অজুদ ফানা হইয়া গিয়াছে এবং আমার রূহ আপনার নূরের সাথে মিশিয়া গিয়াছে। আমার আমিও যখন লয় হইয়া গিয়াছে, তখন আমি আর কোথায় আছি? আমি নাই। আপনিই ছিলেন, আপনিই আছেন, আপনিই থাকিবেন। আপনিতো আপনি, আমিও আপনি। আমি বলিতে আর কিছুই নাই।” (‘আশেক মাশুক বা ইশকে ইলাহী’ সৈয়দ মোহাম্মদ এসহাক রচিত, পৃষ্ঠা নং ৪২।)

অথচ এটি একটি মারাত্মক শিরকী আক্বিদাহ। কেননা আল্লাহ হচ্ছেন খালেক বা সৃষ্টিকর্তা। মানুষ হলো মাখলূক বা সৃষ্টি। সৃষ্ট্রা ও সৃষ্টির মধ্যে একাকার করে দেওয়া এটা হিন্দুদের আকিদাহ । তাদের বিশ্বাস, স্রষ্টার কোন স্বতন্ত্র অস্ত্মিত্ব নেই, সৃষ্টির সবকিছুর মধ্যেই তিনি বিরাজমান। এজন্য তারা বলে থাকে ‘সবকিছুই ঈশ্বর’ তাদের পরিচয়ও হলো ‘সর্বেশ্বরবাদী’ । অথচ মুসলিমদের আক্বিদাহ হলো ‘সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি’। তবে আল্লাহ নয়। মনসূর হাল্লাজের এই ভ্রান্ত আকিদার কারণে বাগদাদের তৎকালিন সমস্ত আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে তাকে হত্যা করা হয়। আর বাগদাদ তখন ছিল বাগদাদ! অর্থাৎ ইসলামী জ্ঞানের প্রাণ কেন্দ্র । এমতাবস্থায় সমস্ত ওলামায়ে কেরামদের কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সর্বসম্মতিক্রমে দেওয়া ফাতওয়াকে উপেক্ষা করে মানসুর হাল্লাজকে আল্লাহর অলী বলে আক্বিদাহ পোষণ করা মূলত: ইসলামী শরিয়াহ ও আলেম ওলামাদের সর্বসম্মত রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করার শামিল । তাছাড়া পীর-সূফীদের এই মহান গুরু মানসুর হাল্লাজ সম্পর্কে ইসলামী ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণ কিতাব ইমাম ইবনে কাসীর রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে বলা হয়েছে:
قَالَ الْخَطِيْبُ فَأَمَّا الْفُقَهَاءُ فَحَكَي عَنْ غَيْرِ وَاحِدٍ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَالْاَئِمَّةِ إِجْمَاعُهُمْ عَلَى قَتْلِهِ، وَأَنَّهُ قُتِلَ كَافِرًا، وَكَانَ كَافِرًا مُمْخَرِقًا
অর্থ: “খতীবে বাগদাদী বলেন: ফুকাহায়ে কেরামদের অনেকেই বলেছেন যে, হাল্লাজকে কতল করার ব্যাপারে ওলামাদের ইজমা হয়েছিল এবং কাফের হিসেবেই তাকে কতল করা হয়েছে । সে ছিল কাফের, মিথ্যাবাদী ।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১১খন্ড ১১৫পৃষ্ঠা।)

এর পর ইবনে কাসির (র:) হাল্লাজের কিছু ভন্ডামি উল্লেখ করেছেন । যার দ্বারা এর স্পষ্ট হয়ে যায় যে হাল্লাজ কোন আল্লাহওয়ালা ছিল না । বরং সে ছিল প্রতারক। তাই যারা মনসুর হাল্লাজকে অনুসরণ করছেন তাদের ভেবে দেখা উচিত । বিশেষ করে বিদায় নিহায়ার ১১খন্ডে উল্লেখিত মানসুর হাল্লাজের জীবনি সকলের পড়া উচিত ।

সূফীদের দলীল হিসাবে পেশ করা আবূ হুরাইরা (রা:) এর উপরোক্ত হাদীসটির জবাবে আমরা বলবো: ঐ হাদীসে মূলত আল্লাহর নুসরাত-সাহায্যের কথা বল হয়েছে। আল্লাহর সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়নি। হাদীসের শেষ অংশে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘সে যদি আমার কাছে কোন কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি । আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই ।’ স্বত্তাগতভাবেই যদি আল্লাহ সঙ্গে মিশে যায় তাহলে আবার আল্লাহর কাছে সাওয়াল করা বা আশ্রয় চাওয়ার প্রয়োজন কি? মূলত: এ জাতীয় বাক্যগুলো সাহায্য-সহানুভূতি করার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন প্রধানমন্ত্রী কাউকে বললো, যাও! অমুক কাজটা তুমি করো আমি তোমার সঙ্গে আছি। এর অর্থ হলো আমার সাহায্য-সহানুভূতি তোমার সঙ্গে থাকবে। এর মানে এই নয় যে, প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে স্বত্তাগতভাবে মিশে যায়। এ বিষয়টি একটি সাধারণ লোকেও বুঝে । কিন্তু সূফিবাদীরা নিজেদের ভ্রান্ত মতের স্বপক্ষে হাদীসটিকে অপব্যবহার করে থাকে ।