বিদআত থেকে সাবধান! 3


মূল বিষয় আলোচনার আগে ১ম পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন আর ২য় পর্ব পড়ার জন্যএখানে ক্নিক করুন।
বিদআত সম্পর্কে  ধারাবাহিক আলোচনার তৃতীয় পর্বে আজকের পোস্টে মোট চারটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। যথা:
১) বিদআতীদের ব্যাপারে মুসলিম মিল্লাতের আলেমদের অবস্থান।
২) বিদআতীদের প্রতিবাদে আলেমগণের পদ্ধতি।
 ৩) সমকালীন বহুল প্রচলিত কতিপয় বিদআতের উদাহরণ।
৪) রবীউল আওয়াল মাসে নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্ম দিবস উপলক্ষে মীলা‏দ মাহফিল উদ্‌যাপন করা।
তাহলে আসুন আজকের বিষয়গুলো পড়ার চেষ্টা করি।
বিদআতীদের ব্যাপারে মুসলিম মিল্লাতের আলেমদের অবস্থান:
যুগে যুগে আহ্‌লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমগণ বিদআতীদের বিদআতী কার্য-কলাপের সামনে কখনই চুপ থাকেন নি। বরং সব সময়ই প্রতিবাদ করত: তাদের কর্মকাণ্ডে বাঁধা দিয়ে এসেছেন। পাঠক সমীপে এ সম্পর্কে কতিপয় দৃষ্টান্ত উপাস্থাপন করা হল:
১) উম্মে দারদা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আবু দারদা রাগান্বিত অবস্থায় একদা আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি বললাম, ব্যাপার কি? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! জামাতে নামায আদায় ব্যতীত মুসলমানদের মধ্যে আমি নবী মুহাম্মাদের (সাঃ) সুন্নাতের কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।
২) আমর বিন ইয়াহয়া হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার পিতাকে আমার দাদা হতে বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমরা একবার ফজরের নামাযের পূর্বে আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রাঃ)এর ঘরের দরজার সামনে বসা ছিলাম। উদ্দেশ্য হল, তিনি যখন বের হবেন, আমরা তার সাথে পায়ে হেঁটে মসজিদের দিকে যাত্রা করব। এমন সময় আমাদের কাছে আবু মূসা আশআরী (রাঃ) আগমন করে বললেন, আবু আব্দুর রাহমান (ইবনে মাসউদের উপনাম) কি বের হয়েছেন? আমরা বললাম, এখনও বের হন নি। তিনিও আমাদের সাথে বসে গেলেন। তিনি যখন বের হলেন, আমরা সকলেই তাঁর কাছে গেলাম। আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বললেন, হে আবু আব্দুর রাহমান! আমি মসজিদে এখনই একটি নতুন বিষয় দেখে আসলাম। আলহামদু লিল্লাহ, এতে খারাপ কিছু দেখিনি। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন সেটি কি? আবু মুসা (রাঃ) বললেন, আপনার হায়াত দীর্ঘ হলে আপনিও তা দেখতে পাবেন। আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বললেন, আমি দেখলাম, মসজিদে একদল লোক বৃত্তাকারে বসে নামাযের অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক দলের মাঝখানে একজন লোক রয়েছে। আর সবার হাতে রয়েছে ছোট ছোট পাথর। মাঝখানের লোকটি বলছে, একশবার আল্লাহু আঁকবার পাঠ কর। এতে সবাই একশবার আল্লাহ্‌ আকবার করে। তএরপর বলে, একশবার আল-হাম্‌দুলিল্লাহ পাঠ কর। এ কথা শুনে সবাই একশবার আ-লহাম্‌দু লিল্লাহ পাঠ করে থাকে। তারপর লোকটি বলে, এবার একশবার সুবহানাল্লাহ্‌ পাঠ কর। সবাই একশবার সুবহানাল্লাহ্‌ পাঠ করে থাকে। এ কথা শুনে ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, তুমি তাদেরকে তাদের পাপের কাজগুলো গণনা করে রাখতে বললে না কেন? আর এটা বললে না কেন যে, তাদের নেকীর কাজগুলো থেকে একটি নেকীও নষ্ট হবে না। কাজেই এগুলো হিসাব করে রাখার কোন দরকার নেই। অতঃপর ইবনে মাসউদ (রাঃ) চলতে থাকলেন। আমরাও তার সাথে চললাম এবং একটি হালাকার (বৈঠকের) কাছে এসে উপস্থিত হলাম। তিনি তাদের কাছে দাড়িয়ে বললেন, একি করছ তোমরা? তারা সকলেই বলল, পাথরের মাধ্যমে গণনা করে আমরা তাকবীর, তাসবীহ্‌ ইত্যাদি পাঠ করছি। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, তাহলে তোমরা তোমাদের পাপের কাজগুলোর হিসাব কর। কারণ পাপের কাজগুলো হিসাব করে তা থেকে তাওবা করা দরকার। আমি এ ব্যাপারে জিম্মাদার হলাম যে তোমাদের ভাল কাজগুলোর একটি ভাল কাজও নষ্ট হবে না। এ কথা বলার কারণ এই যে আল্লাহর কাছে কারও আমল বিনষ্ট হয়না। বরং একটি আমলের বিনিময়ে দশটি ছাওয়াব দেয়া হয় এবং দশ থেকে সাত শত গুণ পযর্ন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উম্মত! অমঙ্গল হোক তোমাদের! কিসে তোমাদেরকে এত তাড়াতাড়ি ধ্বংস করল?!! এখনও নবী মুহাম্মদের (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসংখ্য সাহাবী জীবিত আছেন। এই তো রসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাপড় এখনও পুরাতন হয়নি। তাঁর ব্যবহারকৃত থালা-বাসনগুলো এখনও ভেঙ্গে যায়নি। ঐ সত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা যে দ্বীন তৈরী করেছ তা কি মুহাম্মদের দ্বীন হতে উত্তম? না তোমরা গোমরাহীর দ্বার উন্মুক্ত করেছ? তারা বলল, হে আবু আব্দুর রাহমান! আমরা এর মাধ্যমে কল্যাণ ছাড়া অন্য কোন ই”ছা করিনি। তিনি বললেন অনেক কল্যাণকামী আছে, সে তার উদ্দেশ্য পযর্ন্ত পৌঁছতে পারে না। আল্লাহর নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, একটি দল কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু কুরআন তাদের গলদেশের ভিতরে প্রবেশ করবে না। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মনে হয় তাদের অধিকাংশই তোমাদের মধ্য থেকে বের হবে। অতঃপর ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাদেরকে ছেড়ে চলে আসলেন। আমর ইবনু সালামা (রাঃ) বলেন, আমরা তাদের অধিকাংশকেই দেখলাম, নাহ্‌রাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের সাথে আমাদের বির”দ্ধে একত্রিত হয়েছে।
৩) একজন লোক ইমাম মালিক (রঃ)এর নিকট আগমন করে বলল, আমি কোথা হতে ইহরাম বাঁধব? তিনি বললেন, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহ্‌রাম বাঁধার জন্য যে সমস্ত স’স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেখান থেকে ইহরাম বাঁধ। লোকটি বলল, আমি যদি রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্ধারিত স’ান থেকে আরো একটু দূর হতে ইহরাম বাঁধি, তাহলে কি বৈধ হবেনা? ইমাম মালিক (রঃ) বললেন, আমি ইহাকে বৈধ মনে করিনা। সে বলল, আপনি ইহার মধ্যে অপছন্দের কি দেখলেন? তিনি বললেন, আমি তোমার উপর ফিত্‌নার ভয় করছি। সে বলল, ভাল কাজ বেশী করে করার ভিতর ফিত্‌নার কি আছে? ইমাম মালিক লোকটির এ কথা শুনে বললেন, আল্লাহ তায়া’লা বলেছেন:
فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থঃ অতএব, যারা তাঁর নবীর (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশের বির”দ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিতনা (বিপর্যয়) তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাসি- তাদেরকে আক্রমণ করবে। (সূরা নূর: ৬৩) এর চেয়ে বড় মসিবত আর কি হতে পারে যে, তুমি এমন একটি ফজীলতের মাধ্যমে নিজেকে বৈশিষ্টমন্ডিত করতে চাচ্ছ, যার মাধ্যমে স্বয়ং রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে বৈশিষ্টমন্ডিত করেন নি।
বিদআতের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সালাফদের থেকে এমনি আরো অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ কয়েকটি উদাহরণই পাঠক সমাজের জন্য পেশ করা হল। আশা করি তাই যথেষ্ট হবে।
বিদআতীদের প্রতিবাদে আলেমগণের পদ্ধতিঃ
বিদআতীদের প্রতিবাদে আহ্‌লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমদের পদ্ধতি হলঃ তাঁরা এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাতের উপর নির্ভর করে থাকেন। আর এটিই হল সঠিক ও সন্তোষজনক পদ্ধতি। তাঁরা বিদআতীদের কথাগুলো প্রথমে বর্ণনা করেন। তারপর একটি একটি করে সেগুলো খন্ডন করে থাকেন। সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা ওয়াজিব এবং বিদআত থেকে বিরত থাকা জরুরী, এবিষয়ে তারা কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণাদি উপস্থিত করে থাকেন। বিদআতীদের প্রতিবাদে তাঁরা অসংখ্য বই-পুস্তক-ক রচনা করেছেন। ইসলামের মৌলিক বিষয়ের উপর লিখিত তাঁদের কিতাবগুলোতে তাঁরা খারেজী, যাহ্‌মীয়া, মুতাজেলা এবং আশায়েরা সম্প্রদায়ের রচিত ঈমান ও আক্বীদা বিষয়ক বিদআতী কথাগুলোর উত্তর দিয়েছেন। এব্যাপারে তাঁরা বিশেষ বিশেষ গ্রন্থও রচনা করেছেন। ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল (রাঃ) যাহ্‌মীয়াদের উত্তরে কিতাব লিখেছেন। অন্যান্য ইমামগণও বিভিন্ন ফিরকার লোকদের উত্তরে বিভিন্ন কিতাব রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে উসমান বিন সাঈদ দারেমী, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইবনুল কাইয়িম, শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌হাবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা কবর পূঁজারী, সূফী মতবাদ ও উপরোক্ত বাতিল ফিরকার লোকদের কঠোর প্রতিবাদ করেছেন।
বিদআতীদের প্রতিবাদে যে সমস্ত কিতাব রচিত হয়েছে, তার সংখ্যা অনেক। নিম্মে উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করা হল:
পুরাতন লেখনীগুলোর মধ্যে রয়েছে:
(১) ইক্বতেজাউস্‌ সিরাতিল মুসতাক্বীমঃ কিতাবটি শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) কর্তৃক রচিত। কিতাবের বিরাট একটি অংশ জুড়ে তিনি বিদআতীদের প্রতিবাদ করেছেন।
(২) ইনকার”ল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদাআঃ রচনায় ইবনে ওয়াজ্জাহ
(৩) আল-ইতেসামঃ ইমাম শাতেবী
(৪) আল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদআঃ তারতুসী
(৫) আল বা’ঈছু আলা ইনকারিল বিদ্‌আহ্‌ ওয়াল হাওয়াদেছঃ আবু শামা
(৬) মিনহাজুস্‌ সুন্নাহ আন্‌ নাববীয়াহঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ)। এতে তিনি রাফেজী এবং ক্বাদরীয়া ফিরকার প্রতিবাদ করেছেন।
বর্তমান যুগে বিদআতীদের প্রতিবাদে যে সমস্ত- কিতাব রচিত হয়েছে, তার মধ্যে:
(১) আল ই বদা’উ ফী মাজিল বিদ্‌আহ্‌: শায়খ আলী মাহফুয
(২) আস্‌ সুনানু ওয়াল মুবতাদাআতঃ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আশ্‌-শুকাইরী আল-হাওয়ামেদী।
(৩) আত্‌-তাহজীর” মিনাল বিদআহ্‌ঃ শায়খ ইবনে বায (রঃ) একিতাবটি বাংলাভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
সর্বযুগের আলেমগণই লেখনী, ভাষণ, জুমআর খুৎবা, প্রচার মাধ্যম, পত্রিকা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদআত ও বিদআতীদের প্রতিবাদ করে আস‎ছেন। এসব কর্মতৎপরতা মুসলমানদের সজাগ করণে এবং বিদআতের মূলৎপাটনে যথেষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে।
সমকালীন বহুল প্রচলিত কতিপয় বিদআতের উদাহরণ:
সময়ের প্রবাহ, দ্বীনী ইলম্‌এর স্বল্পতা, বিদআতের দিকে আহ্বানকারীর সংখ্যাধিক্য, ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ এবং কাফেরদের আচার-আচরণের সাথে সাদৃশ্য করণ, ইত্যাদি কারণে বর্তমানে বিদআতের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে, তিনি বলেছেন:
)لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ
অর্থঃ তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী জাতিসমূহের সুন্নাতের অনুসরণ করবে। সমকালীন বিদআত সমূহের মধ্যে থেকে নিম্নে আমরা কতিপয় বিদআতের আলোচনা করব।
১) নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্ম উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্‌ নবী পালন করা।
২) কবর, মাযার ও বিভিন্ন স্থান থেকে বরকত লাভ করা।
৩) ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ইবাদত তৈরী করা।
১) রবীউল আওয়াল মাসে নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্ম দিবস উপলক্ষে মীলা‏দ মাহফিল উদ্‌যাপন করাঃ
অমুসলিম ইয়াহুদ-নাসারাদের অনুসরণ থেকেই এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর জন্ম দিবস উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্‌ নবীর অনুষ্ঠান। অজ্ঞ মুসলমানেরা এবং একদল গোমরাহ্‌ আলেম প্রতি বছর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জন্ম উপলক্ষে রবিউল আওয়াল মাসে এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কেউ কেউ মসজিদে এ অনুষ্ঠান করে থাকে। আবার কেউ ঘর বা বিশেষভাবে এর জন্য প্রস’তকৃত স’স্থানে এ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। আর এতে শত শত সাধারণ লোক উপস্থিত’ত হয়। তারা নাছারাদের অন্ধ অনুসরণ করেই এ অনুষ্ঠানের ব্যবস’া করে থাকে। এঅনুষ্ঠানে বিদআত ও নাসারাদের সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শির্ক ও অপছন্দনীয় কর্ম-কান্ড। এতে এমন কিছু কবিতা আবৃতি করা হয়, যাতে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালামের ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি রয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দু’আ করা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করা পযর্ন্ত- নিয়ে যায়। অথচ রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
অর্থঃ নাসারাগণ যেমন মরিয়মপুত্র ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল, তোমরা আমার ব্যাপারে সেরূপ বাড়াবাড়ি করোনা। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর একজন বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রসূল বল। নাসারারা ঈসা (আঃ)এর মর্যাদা বাড়াতে বাড়াতে আল্লাহর পুত্র হওয়ার আসনে বসিয়েছিল। আবার কেউ কেউ তাঁকে স্বয়ং আল্লাহ হিসাব বিশ্বাস করে তাঁর ইবাদত শুর” করেছে। কেউ বা তাঁকে তিন আল্লাহর এক আল্লাহ্‌ হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছে। কিছু কিছু বিদআতী নবী প্রেমিক বিশ্বাস করে যে, রসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন।
তাছাড়া এ সমস্ত মীলাদ মাহফিলে যে সমস্ত- পাপ কাজের চর্চা করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে দলবদ্ধভাবে গান-বাজনা করা, ঢোল বাজানো এবং সূফীদের বানানো বিদআতী নিয়মে বিভিন্ন জিকির-আজকার করা। কখনও কখনও নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে এ সমস্ত- কাজে অংশ নিয়ে থাকে। যার কারণে অনেক সময় অশালীন কাজকর্ম সংঘটিত হওয়ার সংবাদও শুনা যায়। এমন কি যদি এ সমস্ত অনুষ্ঠস্থান এধরণের অশ্লীল কাজ হতে মুক্ত হয় এবং শুধুমাত্র একত্রিত হয়ে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-ফুর্তির মাঝে সীমিত থাকে, তথাপিও তা বৈধ নয়। কারণ তা নব আবিষ্কৃত বিদআত। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দ্বীনের ব্যাপারে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। তাছাড়া এতে অন্যান্য অনুষ্ঠানের মত অশ্লীল কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদআত বলি। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন আপনারা বিদআত বলেন? উত্তর হলো, আল্লাহর কিতাব, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত, সাহাবিদের আমল এবং সম্মানিত তিন যুগের কোন যুগে এর কোন অসি-ত্ব ছিলনা। তাই আমরা এটাকে বিদআত বলি। কারণ যে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন’ষ্টি কমনা করা হবে, কুরআন বা সুন্নায় অবশ্যই তার পক্ষে একটি দলীল থাকতে হবে। আর মীলাদ মাহফিলের পক্ষে এরকম কোন দলীল নেই বলেই এটি একটি বিদআতী ইবাদত, যা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পর তৈরি করা হয়েছে। মিশরের ফাতেমীয় শিয়া সম্প্রদায়ের শাসকগণ এটাকে সর্বপ্রথম ইসলামের নামে মুসলমানদের মাঝে চালু করে।
বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ইমাম আবু হাফস্‌ তাজুদ্দীন ফাকেহানী (রঃ) বলেন, একদল লোক আমাদের কাছে বার বার প্রশ্ন করেছে যে, কিছু সংখ্যক মানুষ মীলাদ নামে রবীউল আওয়াল মাসে যে অনুষ্ঠান করে থাকে, শরীয়তে কি তার কোন ভিত্তি আছে? প্রশ্নকারীগণ সুস্পষ্ট উত্তর চেয়েছিল। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে উত্তর দিলাম যে, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এর পক্ষে কোন দলীল পাই নি এবং যে সমস্ত- আলেমগণ মুসলিম জাতির জন্য দ্বীনের ব্যাপারে আদর্শ স্বরূপ, তাদের কারও পক্ষ থেকে এধরণেরে আমলের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অথচ তারা ছিলেন পূর্ববর্তী যুগের (সাহাবিদের) সুন্নাতের ধারক ও বাহক। বরং এই মীলাদ নামের ইবাদতটি একটি জঘন্য বিদআত, যা দুর্বল ঈমানদার ও পেট পূজারী লোকদের আবিষ্কার মাত্র।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন, এমনি আরও বিদআতের উদাহরণ হল, কিছু সংখ্যক মানুষ রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিবসকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করত: এ উপলক্ষে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করে থাকে। অথচ রাসূলের (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঠিক জন্ম তারিখ সম্পর্কে আলেমগণ যথেষ্ট মতবিরোধ করেছেন। এ ধরণের অনুষ্ঠান পালনকারীদের দু’টি অবস্থার একটি হতে পারে। হয়ত তারা এব্যাপারে ঈসা (আঃ) এর জন্ম দিবস পালনের ক্ষেত্রে নাসারাদের অনুসরণ করে থাকে অথবা নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি অতি ভালবাসা ও সম্মান দেখানোর জন্য করে থাকে। যাই হোক এ কাজটি সাহাবিদের কেউ করেন নি। যদি কাজটি ভাল হত, তাহলে অবশ্যই তারা কাজটি করার দিকে আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী থাকতেন। তাঁরা রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসতেন এবং সম্মান করতেন। তাঁরা ছিলেন ভাল কাজে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী আগ্রহী। তবে তাদের ভালবাসা ও সম্মান ছিল তাঁর অনুসরণ, আনুগত্য, তাঁর আদেশের বাস্তবায়ন এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তাঁর সুন্নাতকে বাস্তবায়িত করার ভিতরে। তিনি যে দ্বীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, তার প্রচার ও প্রসারের ভিতরে এবং অন্তর-মন, জবান এবং শক্তি দিয়ে সে পথে জিহাদের মাধ্যমে। এটিই ছিল উম্মতের প্রথম যুগের আনসার ও মুহাজেরীনে কেরাম এবং উত্তম ভাবে তাদের অনুসারী তাবেয়ীগণের পথ।
মীলাদ নামের এ বিদআতটির প্রতিবাদে ছোট-বড় অনেক কিতাব রচনা করা হয়েছে। এতে বিদআত ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে অন্যান্য মীলাদ অনুষ্ঠানের দ্বার উন্মুক্ত করার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন মাশায়েখ ও নেতাদের মীলাদ পালন করা, যাতে মন্দ কাজের আরও অনেক দরজা খোলার ভয় রয়েছে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। বর্তমানে এমীলাদ মাহফিল শুধুমাত্র রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জন্ম দিবসের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। এখন নেতা-নেত্রী, পীর-ফকীর, শায়েখ-মাশায়েখ এমনকি সাধারণ মানুষের জন্ম দিবসেও মীলাদ মাহফিল উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে।
শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রঃ) বলেন, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কারও জন্মোৎসব পালন করা জায়েয নয়, বরং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কারণ এটি দ্বীনের মাঝে একটি নতুন প্রবর্তিত বিদআত। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও একাজ করেন নি। তাঁর নিজের বা তাঁর পূর্ববর্তী কোন নবী বা তাঁর কোন আত্মীয়, কন্যা, স্ত্রী অথবা কোন সাহাবীর জন্মদিন পালনের নির্দেশ দেন নি। খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম অথবা তাবেয়ীদের কেউ একাজ করেন নি। এমন কি পূর্ব যুগের কোন আলেমও এমন কাজ করেন নি। তাঁরা সুন্নাহ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞান রাখতেন এবং রসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার শরীয়ত পালনকে সর্বাধিক ভালবাসতেন। যদি এ কাজটি ছওয়াবের হত, তাহলে আমাদের আগেই তাঁরা এটি পালন করতেন।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দ্বীন। এ দ্বীন পরিপূর্ণ বিধায় আমাদেরকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বিদআত থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। রসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমাদের এই দ্বীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। তিনি আরও বলেন, তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রত্যেক নব প্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। এ সমস্ত হাদীছে বিদআত প্রবর্তনের বির”দ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়া’লা বলেন,
 فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থ: অতএব, যারা তাঁর নবীর (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্‌না (বিপর্যয়) তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে। (সূরা নূর: ৬৩) আল্লাহ্‌ তায়ালা আরও বলেন,
وَمَاَآتاَكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا
অর্থ: তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর। এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে তোমরা বিরত থাক। (সূরা হাশরঃ ৭) আল্লাহ্‌ আরও বলেন,
وَلَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُوْلِ اللَّهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ (
অর্থ: তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করে, পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদের জন্য রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবনীতে এক সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আহযাবঃ ২১) আল্লাহ্‌ বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا
অর্থ: আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদাঃ ৩)
এই আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য মনোনীত দ্বীনকে আল্লাহ্‌ তায়া’লা নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ওফাতের পূর্বেই পূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, তাঁর ওফাতের পরে লোকেরা কথায় বা কাজে যে সব নতুন প্রথার উদ্ভাবন করে শরীয়তের সাথে যুক্ত করবে, তা বিদআত হিসাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। যদিও এগুলোর উদ্দেশ্য ভাল হয়। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ বিদআত থেকে জনগণকে সতর্ক করেছেন ও ভয় প্রদর্শন করেছেন। কেননা এটা ধর্মের ভিতরে অতিরিক্ত সংযোজন, যার অনুমতি আল্লাহ্‌ তায়ালা কোন মানুষকে প্রদান করেন নি। ইহা আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান কর্তৃক তাদের ধর্মে নব নব প্রথা সংযোজনের সাথে সামঞ্জস্য স্বরূপ। সুতরাং এরূপ করার অর্থ এই যে, ইসলাম অসম্পূর্ণ ছিল। মীলাদপন্থীরা মীলাদের মাধ্যমে তা পূর্ণ করে দিলেন। এটা যে কত বড় অপরাধ এবং আল্লাহর বাণীর বিরোধী, তা সর্বজন বিদিত। আল্লাহ বলেন: اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। (সূরা মায়েদাঃ ৩)
মীলাদ মাহফিল বা নবীর জন্মোৎসব পালন বা এ জাতীয় অন্যান্য উৎসবাদির প্রবর্তনের দ্বারা এ কথাই বুঝা যায় যে, আল্লাহ্‌ তায়া’লা এই উম্মতের জন্য ধর্মকে পূর্ণতা দান করেন নি এবং রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উপর অর্পিত রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেন নি। পরবর্তীতে মীলাদপন্থীরা এসে তাকে পূর্ণ করে দিয়েছেন। এতে মারাত্মক ভয়ের কারণ রয়েছে এবং এধরণের ইবাদত তৈরি করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তায়া’লা এবং তাঁর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর আপত্তি উত্থাপনের শামিল। অথচ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য ধর্মকে সার্বিকভাবে পূর্ণ করত: তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করেছেন এবং রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের সুস্পষ্ট বার্তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমন কোন পথ, যা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে উম্মতকে তা বলে দিতে কোন ত্রুটি করেন নি।
এ কথা সকলের জানা যে, আমাদের নবী সকল নবীদের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তিনি সবার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের পয়গাম ও উপদেশ বার্তা পৌঁছিয়েছেন। যদি মীলাদ মাহফিল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দ্বীনের অংশ হত, তাহলে তিনি অবশ্যই উম্মতের কাছে বর্ণনা করতেন বা তাঁর সাহাবীগণ তা করতেন। যেহেতু এমন কিছু পাওয়া যায়না, তাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সাথে এই মীলাদ মাহফিলের কোন সম্পর্ক নেই বরং এটা বিদআত, যা থেকে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে সাবধান থাকতে বলেছেন।
যদি আমরা এই মীলাদ মাহফিলের বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন মাজিদের দিকে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাই আল্লাহ তায়া’লা তাঁর রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা আদেশ করেছেন বা যা থেকে নিষেধ করেছেন, তিনি আমাদেরকে তা অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি এই দ্বীনকে উম্মতের জন্য পূর্ণতা দান করেছেন। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে মীলাদ মাহফিলের কোন ইঙ্গিত পযর্ন্ত-নেইেই। এভাবে যদি আমরা সুন্নাতের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই যে, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাজ করেন নি, এর আদেশও দেন নি। এমন কি তাঁর সাহাবীগণও তা করেন নি। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, এটা ধর্মীয় কাজ নয় বরং ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের উৎসব সমূহের অন্ধ অনুকরণ মাত্র। যে ব্যক্তির সামান্যতম বিচক্ষণতা আছে এবং হক গ্রহণে ও তা বুঝার সামান্য আগ্রহ রাখে, তার বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না যে, ধর্মের সাথে মীলাদ মাহফিল বা যাবতীয় জন্ম বার্ষিকী পালনের কোন সম্পর্ক নেই। বরং যে বিদআতসমূহ থেকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করেছেন, এটি সেগুলোরই অন্তর্ভূক্ত।
বিভিন্ন স্থানে অধিক সংখ্যক লোক এই বিদআতী কাজে লিপ্ত দেখে কোন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে প্রবঞ্চিত হওয়া সংগত নয়। কেননা সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সঠিক পথ জানা যায়না। বরং শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা হয়।
এই মীলাদ মাহফিল সমূহ বিদআত হওয়ার সাথে সাথে অনেক এলাকায় অন্যান্য পাপের কাজ থেকেও মুক্ত নয়। যেমন নারী-পুরুষের মেলা-মেশা, গান-বাজনা ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব মাহফিলে শিরকে আঁকবার তথা বড় ধরণের শিরকও সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তা হল রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য আওলীয়ায়ে কেরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কাছে দু’আ করা, সাহায্য ও বিপদ মুক্তির প্রার্থনা করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে তারা গায়েবের খবর জানেন। এই সমস্ত কাজ করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়।
অতীব আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অনেক লোক এ ধরণের বিদআতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই তৎপর ও সচেষ্ট এবং এর পিছনে যুক্তি-প্রমাণ দাঁড় করাতে প্রস্তুত। এধরণের অনুষ্ঠানের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে তারা দ্বিধা বোধ করে না। অথচ তারা নামাযের জামাতে ও জুমাতে অনুপস্থিত থাকাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। যদিও আল্লাহ তা’আলা এ আমলগুলো পালন করা ওয়াজিব করেছেন। তারা এটাও উপলব্ধি করে না যে, নামাযের মত গুরুপূর্ণ ইবাদত ছেড়ে দিয়ে তারা চরম অন্যায় করছে। নিঃসন্দেহে এটা দুর্বল ঈমানের পরিচয় এবং পাপাচারের মাধ্যমে অন্তরকে কুলষিত করে নেয়ার পরিচয় বহন করে।
আরও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, অনেকের ধারণা, রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাড়িয়ে যায়। এটা বিরাট মূর্খতা ও অসত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত দিবসের পূর্বে আপন কবর থেকে বের হবেন না বা কারো সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবেন না এবং কোন সমাবেশেও উপস্থিত’ত হবেন না। বরং কিয়ামত পযর্ন্ত- অন্যান্য নবীদের মতই স্বীয় কবরে অবস্থান করবেন এবং তাঁর পবিত্র রূহ মোবারক প্রভুর নিকট উর্ধাকাশে ইল্লিয়ীনের সম্মানজনক স্থানে সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
ثُمَّ اِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ ثُمَّ اِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ  অর্থ: এরপর তোমাদেরকে অবশ্যই মরতে হবে। অতঃপর কিয়ামতের দিনে পুনরায় জীবিত করা হবে। (সূরা মুমেনুনঃ ১৬) রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার কবরই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করা হবে। আমিই প্রথম সুপারিশ কারী এবং আমার সুপারিশ সবার আগে গৃহীত হবে।
রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর দরূদ পাঠ করা ও সালাম পাঠ করা নিঃসন্দেহে একটি ভাল আমল এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক উত্তম পন্থা। যেমন আল্লাহ তায়া’আলা বলেছেন,
)اِنَّ اللّهَ وَ مَلَائِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ يَاَيُّهَا الَّذِيْنَ اَمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا(
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান। হে মুমেনগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠাও। (সূরা আহযাবঃ ৫৬) নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠায়, আল্লাহ তার প্রতিদান স্বরূপ তাঁর উপর দশবার রহমত নাযিল করেন।
সব সময়ই নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর দরূদ পড়ার বৈধতা রয়েছে। তবে নামাযের শেষে পড়ার জন্য বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে বরং নামাযের মধ্যে শেষ তাশাহ্‌হুদে দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। অনেক ক্ষেত্রে এই দরূদ পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা। যেমন আযানের পরে, জুমআর দিনে ও রাতে এবং রসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালামের নাম উল্লেখ হলে। এব্যাপারে অনেক হাদীছ রয়েছে।
এরূপ বিদআতী অনুষ্ঠান এমন সব মুসলমান দ্বারাও সংঘটিত হচ্ছে, যারা তাদের আক্বীদা ও রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভালবাসার ব্যাপারে খুবই দৃঢ়তা রাখে। তাকে বলতে হবে, যদি তুমি সুন্নী ও রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর অনুসারী হওয়ার দাবী রাখ, তাহলে বল, তিনি স্বয়ং বা তাঁর কোন সাহাবী বা তাঁদের সঠিক অনুসারী কোন তাবেয়ী কি একাজটি করেছেন? না এটা ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান বা তাদের মত আল্লাহর অন্যান্য শত্রুদের অন্ধ অনুকরণ? এধরণের মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রসূল (সসাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর প্রতি ভালবাসা প্রতিফলিত হয়না। যা করলে ভালবাসা প্রতিফলিত হয়, তা হল তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করা, তিনি যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা, যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল সেভাবেই তাঁর উপাসনা করা।
কুরআন ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং খুলাফায়ে রাশেদীন ও তাবেয়ীদের প্রদর্শিত পথে চলার ভিতরেই রয়েছে মুসলমানদের জন্য ইহ ও পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি।
বিদ’আত থেকে সাবধান
শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী