একটি যুবকের কাশ্ফের বয়ান ও সত্তর হাজার বার কালিমা পড়ার ফাযীলাতঃ .!!!

একটি যুবকের কাশ্ফের বয়ান ও সত্তর হাজার বার কালিমা পড়ার ফাযীলাতঃ

শায়েখ আবু করতবী (রহঃ) বলেন, আমি শুনিয়াছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার কালেমা পড়িবে সে দোজখ হইতে নাজাত পাইবে। ইহা শুনিয়া আমি নিজের জন্য সত্তর হাজার বার ও আমার স্ত্রীর জন্য সত্তর হাজার বার এবং এইরূপে এই কালেমা কয়েক নেছাব আদায় করিয়া পরকালের ধন সংগ্রহ করি। আমাদের নিকটেই একজন যুবক কাশফওয়ালা বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। সে নাকি বেহেশেত ও দোজখ দেখিতে পাইত আমি উহাতে সন্দেহ করিতাম। এক সময় ঐ যুবক আমার সহিত আহার করিতে বসিয়া হঠাৎ চিৎকার করিয়া উঠিল ও বলিল, আমার মা দোজখে জ্বলিতেছেন। তাহার অবস্থা আমি দেখিতে পাইতেছি।
যুবকের অস্থিরতা দেখিয়া করতবী (রহ.) বলেন, আমি মনে মনে সত্তর হাজার বার পড়ার একটা নেছাব ঐ যুবকের মায়ের জন্য বখশিশ করিয়া দিলাম, কিন্তু এক আল্লাহ ব্যতীত আমার এই আমলের কথা আর কাহারও জানা ছিল না। হঠাৎ যুবক বিলয়া উঠিল চাচা! আমার মা দোজখের আযাব হতে নাজাত পাইয়া গেলেন। করতবী বলেন, কেচ্ছা দ্বারা আমার দুইটি বিষয়ে জ্ঞান লাভ হইল। প্রথমতঃ ৭০ হাজার বার কালেমা পড়ার বরকত দ্বিতীয়তঃ ঐ যুবকের কাশফের সত্যতাও প্রমাণিত হইল। (ফাজায়েলে আমলের জিকির অধ্যয় ৪৪০-৪৪১ পৃঃ)

পাঠকগণ! লক্ষ্য করুন উক্ত ঘটনা কি মানুষের জন্য ‘ইল্মে গায়িবের প্রমাণ করে না? এই ঘটনার কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয় দেখুন :

১) শায়খ আবূ কুরতুবী (রহ.) বলেন, আমি শুনেছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার কালিমা পড়বে বলে যে উল্লেখ আছে তা আবূ কুরতুবী কোথা থেকে শুনেছেন? এ ধরনের কথা তো রসূল (সাঃ) কোন সহাবীকে বলতে পারতেন?

২) আফসোস! কোন হাদীসের গ্রন্থে এ ধরনের কথা পাওয়া যায় না তাহলে কুরতুবী সাহেব এটা পেলেন কোথায়?

৩) কুরতুবী সাহেবের অভিজ্ঞতার দ্বারা যে সবক (নাসীহাত) পাওয়া গেল তা হল নিসাব জমা করতে হবে। আর মুর্দার প্রতি বখশিশ করাতে হবে।

৪) এছাড়া কাশ্ফ (অর্থাৎ উঠান বা উন্মোচন করা) জান্নাত এবং জাহান্নাম যা আল্লাহ তা‘আলা গায়িবে (অদৃশ্যে) রেখেছেন তার পর্যবেক্ষণ করা, নিজ মাকে জাহান্নামে দেখা এবং তার মাগফিরাত (ক্ষমা) দেখা ইত্যাদি সব ‘ইল্মে গায়িব অর্থাৎ অদৃশ্য জগতের কথা নয় কি? যা কাশ্ফের মাধ্যমে জানা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, শাইখুল হাদীস সাহেবের বর্ণনানুযায়ী এই উম্মাতের মধ্যে ‘ইল্মে গায়িব অর্থাৎ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখনেওয়ালার সংখ্যা অগণিত। অথচ কুরআন মাজীদে আছে যে, আল্লাহ ছাড়া গায়িব কেউ জানে না।

মহান আল্লাহ বলেন :
{قُلْ لاَ يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلاَّ اللهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ}
“বলুন, আল্লাহ ব্যতীত নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে কেউ গায়িবের খবর জানে না এবং তারা জানে না যে, তারা কখন পুনরুজ্জীবিত হবে।”(সূরা আন-নাম্ল ৬৫)

নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা দেন :
{قُلْ لاَ أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللهِ وَلاَ أَعْلَمُ الْغَيْبَ}
“হে নাবী! আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহ্র ধন-ভাণ্ডার রয়েছে এবং আমি গায়িবের খবর জানি।”(সূরা আন‘আম ৫০)

মহান আল্লাহ আরও বলেন :
{وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَ سْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ}
“হে নাবী! আপনি বলুন, আমি যদি গায়িবের খবর জানতাম তাহলে আমি আমার বহু মঙ্গল সাধন করতাম এবং কোন অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারত না।”(সূরা আল-আ’রাফ ১৮৮)

তাছাড়া সূফী নামধারী ব্যক্তিরাই এটাকে হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন, যেহেতু শাইখুল হাদীস সাহেব বর্ণনা করেছেন । সেহেতু অনেকের এটা হাদীস ভাবারই কথা যেমন : من هلل سبعين الف مرة واهده للميت يكون براءة للميت من النار (لا اله الا الله) অর্থাৎ সত্তর হাজার বার কালিমা ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করে এর সওয়াব মৃত ব্যক্তির নামে উৎসর্গ করলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।” এ কথাটি অনেকের মুখে হাদীসে রসূল (সাঃ) হিসাবে প্রসিদ্ধ।

তাবলীগী মুবাল্লিগসহ বহু এলাকার মানুষকে তা বলতে শোনা যায়; অথচ তা রসূল (সাঃ)-এর হাদীস হিসাবে প্রমাণিত নয়।

ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন : ليس هذا حديث صحيحا و لا ضعيفا “এটি সহীহ বা যঈফ কোন সনদে বর্ণিত নেই।” (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়াহ ২৪/৩২৩Ñ গৃহীত, প্রচলিত জাল হাদীস পৃঃ ১৬২)

উল্লেখিত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, এটি জাল হাদীস কারণ তার কোন সূত্র নেই। আর জাল বা ভিত্তিহীন রিওয়ায়াত বর্ণনা করা কবীরা গুনাহ। তাই বিষয়টি হালকা করে দেখার কোন অবকাশ নেই। প্রমাণহীন কোন কিছুকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীস বলে দাবী করা ইসলামে জঘন্যতম কবীরা গুনাহ বলে সাব্যস্ত। তাই এ ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে জাহান্নামের হুঁশিয়ারী পর্যন্ত এসেছে।

তিনি (সাঃ) বলেন :
من كذب على متعمدا فليتبوا مقعده من النار (متفق عليه)
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা খুঁজে নেয়।”(সহীহ বুখারী ১/২১, হাঃ ১১০; সহীহ মুসলিম ১/৭, হাঃ ৩)

অন্য হাদীসে আছে :
ان كذبا على ليس ككذب على احد فمن كذب على متعمد فليتبوا مقعده من النار
“আমার উপর মিথ্যারোপ করা, অন্য কারো উপর মিথ্যারোপ করার মত নয়। যে আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।”(সহীহুল বুখারী ১/৭২, হাঃ ১২৯১; সহীহ মুসলিম ১/৭, হাঃ ৪)

রসূলুল্লাহ (সাঃ) যেহেতু দ্বীনী ব্যাপারে ওয়াহী ছাড়া কোন কথা বলতেন না, তাই কোন কথা হাদীসে নাববী হওয়ার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এটি তাঁর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার ওয়াহী ও পয়গাম। সুতরাং যদি কোন কথা রসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেননি; তথাপিও তার বরাত দেয়া হয়, তাহলে তার মধ্যে খারাবী ও ক্ষতি শুধু এতটুকু নয় যে, এটি রসূলের উপর মিথ্যারোপ করা হচ্ছে, বরং পরোক্ষভাবে আল্লাহ তা‘আলার উপরও মিথ্যারোপ করা হচ্ছে। আর আল্লাহ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করা কত জঘন্য অপরাধ তা কারো অজানা নয়।

ইরশাদ হচ্ছে :
{وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَر‘ى عَلَى اللهِ كَذِباً أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلَى رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الأَ<شْهَادُ هَؤُلاءِ الَّذِينَ كَذَبُوْا عَلٰى رَبِّهِمْ أَلاَ لَعْنَةُ اللهِ عَلٰى الظَّالِمِينَ}
“আর ঐ ব্যক্তির চেয়ে যালিম কে যারা আল্লাহ্র প্রতি মিথ্যারোপ করে। তাদেরকে তাদের পালনকর্তার সম্মুখীন করা হবে, আর সাক্ষীগণ বলতে থাকবে, এরাই ঐলোক যারা আপন পালনকর্তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। সাবধান যালিমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে।”(সূরা আল-হূদ ১৮)

এসব কারণেই হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ফরয সতর্কতার একমাত্র পথ এই যে, হাদীস বিশেষজ্ঞদের নিকট সে সব, কিতাবের নাম জেনে নেয়া যেগুলোতে শুধু সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে। (যেমন সহীহ আল-বুখারী, সহীহ মুসলিম)

এতদ্ভিন্ন অন্য কিতাব থেকে হাদীস গ্রহণের সময় বিশেষজ্ঞদের নিকট জেনে নেয়া যে হাদীসটি সহীহ কিনা। (যেমন বর্তমান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস সুনানে আরবায়া’র সহীহ ও যঈফ হাদীসগুলিকে যাচাই বাছাই করে আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন যা আরব বিশ্বে বহুল প্রচলিত। যে সূর্য আমাদের দেশে এখান উদিত হয়নি।) উম্মাতের সচেতন ব্যক্তিদের মাঝে আজও এ নিয়মই বিদ্যমান আছে। যেমন আল্লামাহ নাসীরুদ্দীন (রহ:) সুনানে আরবায়া’ তথা আবূ দাউদ, তিরমিযী নসাঈ ও ইবনু মাজাহ জাল ও যঈফ হাদীস গুলো পৃথক করে যে স্বতন্ত্র গ্রন্থে একত্রিত করেছেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হল। আবূ দাউদে ১১২৭ টি যঈফ তিরমিযীতে ৮২৮ টি যঈফ, নাসাঈতে ৪৪০ টি যঈফ এবং ইবনু মাজাহতে ৯৪৮ টি যঈফ হাদীস রয়েছে মোট যঈফ হাদীস ৪টি গ্রন্থে ৩৩৪৪ টি।(আত-তাহারীক ডিসেম্বর ২০০৭, ৩য় সংখ্যা পৃষ্ঠা ১৪)


[সংগ্রহ ও সংযুক্তঃ মুরাদ বিন আমাজাদের সহীহ আক্বীদার মানদণ্ডে তাবলীগী নিসাব পৃঃ ২৮-৩২]
— with Albani Islam and 41 others.