রামাযান মাসে তারাবী নামাযের রাকআত সমস্যার সমাধান

মূলঃ আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন 

অনুবাদঃ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী সম্মানিত শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-উছাইমীন (রঃ) বলেনঃ সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজ গতের প্রভু আল্লাহ তাআলার জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ), তাঁর পরিবার এবং তাঁর সকল সাহাবীর উপর।অতঃপর আমি তারাবীর নামায বিষয়ে একটি লিফলেট দেখতে পেলাম, যা মুসলমানদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। আমি আরও জানতে পারলাম যে, প্রবন্ধটি কতিপয় মসজিদে পাঠ করা হয়েছে। প্রবন্ধ বা লিফলেটটি খুবই মূল্যবান। কেননা লেখক তাতে তারাবীর নামাযে খুশু-খুযু এবং ধীরস্থিরতা অবলম্বনের উপর উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে ভাল কাজের বিনিময়ে ভাল পুরস্কার দান করুন। তবে প্রবন্ধটির মধ্যে বেশ কিছু আপত্তি রয়েছে, যা বর্ণনা করা ওয়াজিব মনে করছি। লেখক সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন। এর জবাব হচ্ছে এই হাদীছটি যঈফ। ইবনে হাজার আসকালানী সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা ফতহুল বারীতে বলেনঃ وأما ما رواه ابن أبي شيبة" من حديث ابن عباس كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي في رمضان عشرين ركعة والوتر، فإسناده ضعيف، وقد عارضه حديث عائشة هذا الذي في الصحيحين مع كونها أعلم بحال النبي صلى الله عليه وسلم ليلاً من غيرها. যে হাদীছটি ইবনে আবী শায়বা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি ও বিতর পড়তেন-তার সনদ দুর্বল। আর এটি বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আয়েশা (রাঃ)এর হাদীছের বিরোধী। আয়েশা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাতের অবস্থা অন্যদের চেয়ে বেশী জানতেন। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে হাদীছটির প্রতি ফতহুল বারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী ইঙ্গিত করেছেন, তা ইমাম বুখারী এবং মুসলিম স্বীয় কিতাবদ্বয়ে উল্লেখ করেছেন। আবু সালামা আব্দুর রাহমান আয়েশা (রাঃ)কে জিজ্ঞেস করলেনঃ রামাযান মাসে নবী (সাঃ)এর নামায কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায ১১ রাকআতের বেশী পড়তেন না। (বুখারী) মুসলিমের শবেদ বর্ণিত হয়েছে, তিনি প্রথমে আট রাকআত পড়তেন। অতঃপর বিতর পড়তেন। আয়েশা (রাঃ)এর হাদীছে জোরালোভাবে এই সংখ্যার উপর যে কোন সংখ্যা অতিরিক্ত করার প্রতিবাদ করা হয়েছে।ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী (সাঃ)এর রাতের নামাযের ধরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি দুই রাকআত নামায পড়তেন, অতঃপর আরও দুই রাকআত পড়তেন। তারপর আরও দুই রাকআত, এভাবে ১২ রাকআত পূর্ণ করে বিতর পড়তেন। (সহীহ মুসলিম) এতে পরিস্কার হয়ে গেল যে তাঁর রাতের নামায ১১ রাকআত বা ১৩ রাকআতের মধ্যেই ঘুর্ণয়মান ছিল। এখন যদি বলা হয় রাতের নামায (তাহাজ্জুদ) আর তারাবীর নামায এক নয়। কেননা তারাবী হচ্ছে উমার (রাঃ)এর সুন্নাত। তাহলে উত্তর কি হবে? এ কথার উত্তর হচ্ছে, রামাযান মাসে রাসূল (সাঃ)এর রাতের নামাযই ছিল তারাবী। সাহাবীগণ এটিকে তারাবী নাম দিয়েছেন। কেননা তারা এটা খুব দীর্ঘ করে পড়তেন। অতঃপর তারা প্রত্যেক দুই সালামের পর বিশ্রাম নিতেন। তারাবী অর্থ বিশ্রাম নেওয়া। তারাবী রাসূল (সাঃ)এরই সুন্নাত ছিল। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, কোন এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নামায পড়লেন। তাঁর নামাযকে অনুসরণ করে কিছু লোক নামায পড়ল। অতঃপর দ্বিতীয় রাতেও নামায পড়লেন। এতে লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। অতঃপর তৃতীয় বা চতুর্থ রাতে প্রচুর লোকের সমাগম হল। কিন্তু রাসূল (সাঃ) এবার ঘর থেকে বের হয়ে তাদের কাছে আসলেন না। সকাল হলে তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের কাজ-কর্ম প্রত্যক্ষ করেছি। আমাকে তোমাদের কাছে বের হয়ে আসতে কোন কিছুই বারণ করে নি, কিন্তু আমি ভয় করলাম যে, তা তোমাদের উপর ফরজ করে দেয়া হয় কি না? আর এটি ছিল রামাযান মাসে। (বুখারী ও মুসলিম) আর যদি বলা হয়, নবী (সাঃ) ১১ রাকআত পড়েছেন। তার চেয়ে বেশী পড়তে নিষেধ করেন নি। সুতরাং রাকআত বাড়ানোর মধ্যে বাড়তি ছাওয়াব ও কল্যাণ রয়েছে। তার উত্তরে আমরা বলবো যে, কল্যাণ ও ছাওয়াব হয়ত ১১ রাকআতের মধ্যেই সীমিত। কারণ এটি রাসূল (সাঃ)এর আমল দ্বারা প্রমাণিত। আর সর্বোত্তম হেদায়াত হচ্ছে রাসূল (সাঃ)এর হেদায়াত। সুতরাং তাই যদি হয় তাহলে কল্যাণ ও বরকত ১১ রাকআতের মধ্যেই। আর যদি বিশ্বস করেন যে বাড়ানোর মধ্যেই কল্যাণ, তাহলে বুঝা যাচ্ছে রাসূল (সাঃ) কল্যাণ অর্জনে ত্র“টি করেছেন এবং উত্তম বিষয়টি তার উম্মাতের জন্য গোপন করেছেন। নাউযুবিল্লাহ, এ ধরণের বিশ্বাস রাসূল (সাঃ)এর ক্ষেত্রে অসম্ভব। মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন (রঃ) আরও বলেনঃ যদি বলা হয় ইমাম মালেক তার মুআত্তা গ্রন্থে ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে বর্ণনা করেছেন যে, عن يزيد بن رومان قال: كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَانِ عُمَرَ بنِ الخَطَّابِ فِي رَمَضَانَ بِثَلاثٍ وَعِشرِينَ رَكعةً ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে বর্ণিত, লোকেরা উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)এর আমলে রামাযান মাসে কিয়ামুল লাইল (বিতরসহ) ২৩ রাকআত আদায় করতেন। এই হাদীছের জবাবে কি বলবেন? এর জবাব হচ্ছে, হাদীছটি দুর্বল ও সহীহ হাদীছের বিরোধী। (১) দুর্বল হওয়ার কারণ হচ্ছে, তার সনদে ইনকিতা রয়েছে। অর্থাৎ কোন একজন রাবী বাদ পড়েছে। কারণ ইয়াজিদ বিন রুমান উমার (রাঃ)এর যুগ পায় নি। যেমন ইমাম নববী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ ঘোষণ করেছেন। (২) ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছটি ইমাম মালেক (রঃ) তাঁর মুআত্তা গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য রাবী মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ সায়েব বিন ইয়াজিদ থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীছের বিরোধী। সায়েব বিন ইয়াজিদ বলেনঃ أمر عمر بن الخطاب أبي بن كعب وتميماً الداري أن يقوما للناس بإحدى عشرة ركعة উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) উবাই বিন কা’ব এবং তামীম দারীকে মানুষের জন্য ১১ রাকআত তারাবীর নামায পড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন। দেখুনঃ (দেখুন শরহুয যুরকানী ১/১৩৮) সুতরাং সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছ তিনটি কারণে ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য। ক) সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছ নবী (সাঃ) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীছের মোতাবেক। উমার (রাঃ) এ ব্যাপারে রাসূল (সাঃ)এর সুন্নাত জানা সত্ত্বে কখনই তা বাদ দিয়ে অন্যটি নির্বাচন করতেদ পারেন না। খ) ১১ রাকআতের ব্যাপারে সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছটি সরাসরি উমার (রাঃ)এর আদেশের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আর ইয়াজিব বিন রুমানের হাদীছটি উমার (রাঃ)এর যামানার দিকে নিসবত করা হয়েছে। সুতরাং ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছে বর্ণিত ২০ রাকআতের উপর উমার (রাঃ)এর সমর্থন বুঝায়। আর আদেশ সমর্থনের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়। কেননা ১১ রাকআত তাঁর সরাসরি আদেশ দ্বারা প্রমাণিত। আর সমর্থন কখনও বৈধ বিষয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে, যদিও তা পছন্দের বাইরে হয়। সুতরাং উমার (রাঃ) ২৩ রাকআতের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকতে পারেন। কেননা রাসূল (সাঃ) থেকে এ ব্যাপারে নিষিদ্ধতা পাওয়া যায় না। সাহাবীগণ এ ব্যাপারে ইজতেহাদ করেছিলেন। আর তিনি তাদের ইজতেহাদকে সমর্থন করেছেন। অথচ তিনি ১১ রাকআতই নির্বাচন করে তা আদায় করার আদেশ দিয়েছিলেন। গ) ১১ রাকআতের ব্যাপারে সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছটি দোষ থেকে মুক্ত। তার সনদ মুত্তাসিল। আর ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছ দুর্বল। সায়েব বিন ইয়াজিদ থেকে বর্ণনা করেছেন মুহম্মাদ বিন ইউসুফ। তিনি ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে অধিক নির্ভর যোগ্য। কেননা মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি ছিলেন ثقة ثبت (ছিকাহ ছাবেত)। আর ইয়াজিদ বিন রুমান সম্পর্কে মুহাদ্দিছগণ বলেছেন যে, তিনি শুধু ثقة (ছিকাহ)। আর উসুলে হাদীছের পরিভাষায় ছিকাহ ছাবেত রাবীর বর্ণনা শুধু ছিকাহ রাবীর বর্ণনা থেকে অধিক গ্রহণযোগ্য। الذي قيل فيه ثقة ثبت مرجح على الذي قيل فيه ثقة فقط كما في مصطلح الحديث আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ২৩ রাকআতের ব্যাপারে ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদিছটি প্রমাণিত এবং সায়েব বিন ইয়াজিদের বিরোধী নয়, তারপরও রাসূল (সাঃ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত ১১ রাকআতের উপর ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছে বর্ণিত ২৩ রাকআতকে প্রাধান্য দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ রাসূল (সাঃ) রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায ১১ রাকআতের বেশী কখনই পড়েন নি। সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে যেহেতু আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেছে, তাই মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে আমাদের করণীয় কি? অবশ্যই আল্লাহ তাআলা এরূপ বিষয়ে আমাদের জন্য সমাধানের ব্যবস্থা করেছেন এবং আমাদেরকে তার কিতাবের দিকে ফেরত যেতে বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ يا أيها الذين آمنوا أطيعوا الله وأطيعوا الرسول وأولي الأمر منكم فإن تنازعتم في شيء فردوه إلى الله والرسول إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الآخر ذلك خير وأحسن تأويلا “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্র নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ্ ও তার রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ্ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা নিসাঃ ৫৯) সুতরাং মতবিরোধের সময় আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের দিকে ফিরে যাওয়া আবশ্যক করে দিয়েছেন এবং রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁর কাছে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুন্নাতের দিকে ফিরে আসতে বলেছেন। আর এটাকেই তিনি কল্যাণ এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তআলা আরও বলেনঃ فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً “অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে। (সূরা নিসাঃ ৬৫) এখানে আল্লাহ তাআলা মানুষের পারস্পরিক বিরোধের সময় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুমের দিকে ফিরে যাওয়াকে ঈমানের দাবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর আল্লাহ কসম করে বলেছেন যে, যারা রাসূলের হুকুমের সামনে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পন না করবে এবং খুশী মনে তা না মানবে, নিঃসন্দেহে তাদের ঈমান চলে যাবে। রাসূল (সাঃ) তাঁর খুতবাসমূহে সবসময় বলতেনঃ সর্বোত্তম কালাম হচ্ছে আল্লাহর কিতাব আর সর্বোত্তম সুন্নাত হচ্ছে রাসূলরে সুন্নাত। মুসলমানগণ এ ব্যাপারে একমত যে মুহাম্মাদ (সাঃ)এর সুন্নাত হচ্ছে সর্বোত্তম পথ। মানুষ জ্ঞানে ও আমলে যতই বড় হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই তার কথাকে রাসূলের কথার উপর প্রাধান্য দেয়া যাবে না এবং তার কথাকে নবী (সাঃ)এর কথার চেয়ে উত্তম মনে করা যাবে না। সাহাবীগণ রাসূল (সাঃ)এর কথার বিরোধীতা করতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করতেন। এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাস (রাঃ)এর কথাটি কতই না বলিষ্ঠ। তিনি বলেনঃ আমি বলছি, রাসূল (সাঃ) বলেছেন আর তোমরা আমার কথার বিরোধীতা করে বলছ আবু বকর ও উমার বলেছেন। আমার আশঙ্কা হচ্ছে তোমাদের এই কথার কারণে আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ করে তোমাদেরকে ধ্বংস করা হয় কি না। (দেখুনঃ যাদুল মাআদঃ ২/১৯৫) এখন যদি কোন মুসলিমকে বলা হয় রাসূল (সাঃ) মানুষকে নিয়ে ১১ রাকআত তারাবী পড়তেন। আর উমুক ইমাম মানুষকে নিয়ে ২৩ রাকআত পড়াচ্ছেন, তার জন্য রাসূল (সাঃ)এর সুন্নাত বাদ দিয়ে কোন ক্রমেই অন্যের সুন্নাত গ্রহণ করা বৈধ হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত মোতাবেক আমল করাই অধিক উত্তম। আর অধিক উত্তম আমলের জন্যই মানুষ, আসমান-যমীন এবং সকল বস্তু সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে অধিক উত্তম? (সূরা মূলকঃ ২) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً “তিনিই আসমান ও যমীন ছয় দিনে তৈরি করেছেন, তার আরশ ছিল পানির উপরে, তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে ভাল কাজ করে। (সূরা হুদঃ ৭) আল্লাহ তাআলা এ কথা বলেন নি যে, তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশী আমল করে? এটি জানা কথা যে, আমলের মধ্যে ইখলাস অর্থাৎ একনিষ্ঠতা যত বেশী হবে এবং সুন্নাতের অনুসরণ যত বেশী করা হবে, আমলটি তত বেশী উত্তম হবে। সুতরাং ১১ রাকআত রাসূল (সাঃ)এর সুন্নাতের মোতাবেক হওয়ার কারণে বাড়ানোর চেয়ে ১১ রাকআত পড়াই উত্তম। বিশেষ করে যখন ধীরস্থীরভাবে, ইখলাসের সাথে এবং খুশু-খুযুর সাথে এই ১১ রাকআত পড়া হবে। যাতে ইমাম ও মুক্তাদী সকলেই দুআ এবং যিকিরগুলো সুন্দরভাবে পড়তে পারবে। যদি বলা হয় ২৩ রাকআত পড়া তো আমীরুল মুমিনীন খলীফা উমার (রাঃ)এর সুন্নাত। তিনি খোলাফায়ে রাশেদার একজন। তাদের অনুসরণ করার জন্য আমাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ তোমরা আমার পরে আমার সুন্নাত ও সঠিক পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতে অনুসরণ করবে। এ কথার জবাবে বলবো যে, ঠিক আছে। উমার (রাঃ) খোলাফায়ে রাশেদার অন্তর্ভূক্ত। তাদের অনুসরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের ভালভাবে জানতে হবে তারাবীর রাকআত সংখ্যার ব্যাপারে উমার (রাঃ)এর সুন্নাতটি কি? অনুসন্ধান করে আমরা যা জানতে পারলাম, তা হচ্ছে ২৩ রাকআতের বর্ণাগুলো দুর্বল ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত সহীহ হাদীছের বিরোধী। বরং সহীহ সনদে উমার (রাঃ) উবাই বিন কা’ব ও তামীম দারীকে ১১ রাকআত পড়ানোর আদেশ দিয়েছেন বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে উমার (রাঃ)২৩ রাকআত নির্ধারণ করেছেন, তারপরও রাসূর (সাঃ)এর আমলের বিরুদ্ধে তাঁর কথা দলীল হতে পারে না। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত, সাহাবীদের কথা এবং মুসলমানদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যে, কারও কথা রাসূলের সুন্নাতের সমান হতে পারে না। সে যত বড়ই হোক না কেন? কারও কথা টেনে এনে রাসূলের সুন্নাতের বিরুদ্ধে দাড় করা যাবে না। ইমাম শাফেই (রঃ) বলেনঃ أجمع المسلمون على أن من استبانت له سنة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يحل له أن يدعها لقول أحد মুসলমানদের সর্বসম্মতিক্রমে কারও কাছে রাসূলের সুন্নাত সুস্পষ্ট হয়ে যাওযার পর তা ছেড়ে দিয়ে অন্যের কথা গ্রহণ করা জায়েয নয়। যারা বলেনঃ সাহাবীদের যামানা থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানগণ ২৩ রাকআত পড়ে আসছেন। সুতরাং তা ইজমার মত হয়ে গেছে। তাদের এই কথা সঠিক নয়। সাহাবীদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে তারাবীর রাকআত সংখ্যার ব্যাপারে খেলাফ (মতবিরোধ) চলেই আসছে। হাফেজ ইমাম ইবনে হাজার আসকালী (রঃ) ফতহুল বারীতে এ ব্যাপারে মতপার্থক্যের কথা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আবান বিন উছমান এবং উমার বিন আব্দুল আজীজের আমলে মদীনাতে ৩৩ রাকআত তারাবী পড়া হতো। ইমাম মালেক (রঃ) বলেন একশ বছরেরও বেশী সময় পর্যন্ত চলমান ছিল। (দেখুন ফতহুল বারী আলমাকতাবা সালাফীয়া ৪/২৫৩) সুতরাং যেহেতু মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতভেদ চলে আসছে, তাই কুরআন ও সুন্নার দিকে ফিরে আসাতেই রয়েছে এর সমাধান। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ فإن تنازعتم في شيء فردوه إلى الله والرسول إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الآخر ذلك خير وأحسن تأويلا “তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ্ ও তার রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ্ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা নিসাঃ ৫৯) সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জগতের প্রভু আল্লাহ তাআলার জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী, তার পরিবার এবং সকল সাহাবীর উপর মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীনঃ ০৮/০৯/১৩৯৫ হিজরী।