সংক্ষেপে হাদীস সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচারের ইতিহাস


সংক্ষেপে হাদীস সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচারের ইতিহাস


সংক্ষেপে হাদীস সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচারের ইতিহাস
আমরা এ প্রজন্মের মানুষের মধ্যে হাদীস সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচার নিয়ে নানা ধরণের প্রচারণায় বিভ্রান্ত। এখানে এ যুগের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব প্রফেসর ডাঃ মোঃ মাতিয়ার রহমান সাহেবের গবেষণা সিরিজ ১৯ সংগৃহিত। কৃতজ্ঞতা- কোরান রিচার্স ফাউন্ডেশন।
রাসূল (সা.) এর মক্কী জীবনের সময় হাদীস সংক্ষরণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
নবুয়াতের শুরু থেকেই কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে সাথে নিজের তত্ত্বাবধানে রাসূল (সা.) তা লিখে রাখার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু শুরু থেকে যত দিন পর্যন্ত মুসলমানরা বর্ণনা ভঙ্গি, উপস্থাপন পদ্ধতি, বিষয়বস্তু ইত্যাদি দেখে কোনটি কুরআনের আয়াত আর কোনটি তা নয়, এটি বুঝতে পারার যোগ্যতা অর্জন করেনি ততদিন পর্যন্ত হাদীস লিখতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন। এটি তিনি করেছিলেন কুরআনের সাথে তাঁর কথা মিশে যাওয়ার মাধ্যমে ইসলামের অকল্পনীয় ক্ষতি এড়ানোর জন্যে। হাদীস সংগ্রহ এ বিষয়ে তাঁর যে বক্তব্য পাওয়া যায় তার একটি হচ্ছে-
لاَ تَكْتُبُوا عَنِّي وَمَنْ كَتَبَ عَنِّي غَيْرَ الْقُرْآنِ فَلْيَمْحُهُ وَحَدِّثُوا عَنِّي وَلاَ حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
অর্থ: আমার বলা কথা লিখ না। কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু কেউ লিখে থাকলে তা মুছে ফেল। তবে আমার কথা মৌখিকভাবে বর্ণনা করায় দোষ নেই। আর আমার নামে যে মিথ্যা প্রচার করবে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা খুঁজে নেয়। (মুসলিম : আবু সাইদ খুদরী (রা.)
রাসূল (সা.) এর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে মক্কী জীবনে হাদীস লিখে সংক্ষরণ করা হয়েছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তখন হাদীস সংরণের একমাত্র উপায় ছিল মুখস্থ রাখা। আর হাদীস প্রচারের একমাত্র উপায় ছিল মৌখিক প্রচার।
রাসূল (সা.) এর মাদানী জীবনের সময় হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
হিজরতের পর তথা নবুয়্যাতের ১৩-১৪ বছর পর মুসলমানরা যখন, কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য স্পষ্টভাবে বুঝার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তখন রাসূল (সা.) হাদীস লেখার সাধারণ অনুমতি দেন। এ ব্যাপারে উপস্থিত থাকা রাসূল (সা.) এর কয়েকটি হাদীসের একটি হচ্ছে-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.) এর হতে শোনা প্রতিটি কথা সংরণের জন্যে লিখে নিতাম। এটি দেখে কুরাইশ সাহাবীগণ আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করেন। আমাকে তাঁরা বলেন- أَتَكْتُبُ كُلَّ شَيْءٍ تَسْمَعُهُ، وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَشَرٌ يَتَكَلَّمُ فِي الْغَضَبِ وَالرِّضَا؟
অর্থ: তুমি রাসূল (সা.) এর মুখে যা শোন তা সবই লিখে রাখ? অথচ রাসূল (সা.) একজন মানুষ। তিনি কখনও সন্তোষ ও কখনও রাগের মধ্যে থেকে কথা বলেন। (আবু দাউদ, কিতাবুল ইলম)
হজরত আবদুল্লাহ বলেন, অতঃপর আমি হাদীস লেখা বন্ধ করে দেই এবং একদিন রাসূল (সা.) এর নিকট বিষয়টি উপস্থাপন করি এবং বলি, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কুরাইশরা বলে তুমি রাসূলের সব কথাই লিখছ? অথচ তিনি একজন মানুষ। সাধারণ মানুষের মত তিনি কখনও কখনও রাগান্বিত হয়ে থাকেন’। রাসূল (সা.) এ কথা শুনার সাথে সাথে নিজের দুই ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বললেন-اُكْتُبْ فَوَ الَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ اِلاَّ الْحَقّ.
অর্থ: তুমি লিখতে থাক। যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, আমার এই মুখ হতে প্রকৃত সত্য কথা ছাড়া কিছুই বের হয় না।
এ কথা শুনার পর হজরত আবদুল্লাহ (রা.) রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন-يَا رَسُوْلَ اللهِ اَكْتُبُ كُلَّ مَا اَسْمَعُ مِنْكَ.
অর্থ: হে রাসূল (সা.) আপনার নিকট থেকে যা কিছু শুনতে পাই তা সবই কি লিখে রাখব? রাসূল (সা.) বললেন,………..(হ্যাঁ)। আবদুল্লাহ (রা.) পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, ক্রুদ্ধ ও সন্তোষ উভয় অবস্থায় বলা সব কথাই কি লিখব? তখন রাসূল (সা.) চূড়ান্তভাবে বললেন-
نَعْمْ فَاِنِّىْ لاَ اَقُوْلُ فِىْ ذَلِكَ كُلِّهِ اِلاَّ حَقًّا. অর্থ: হ্যাঁ এ সকল অবস্থায়ও আমি প্রকৃত সত্য ছাড়া কিছুই বলি না।
(দারেমী, আবু-দাউদ, মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকেম, জামে বায়ানুল ইলমে ইবানুল বার)
এ ধরনের কিছু হাদীস থেকে জানা যায় মাদানী জীবনে রাসূল (সা.) হাদীস লেখার সাধারণ অনুমতিই শুধু দেননি হাদীস লেখার পথে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তিনি তা দূর করে দিতেন। রাসূল (সা.) এর অনুমতি ও উৎসাহ পেয়ে এবং হাদীস নির্ভুলভাবে সংরণের গুরুত্ব অনুভব করে যে সকল সাহাবী লেখাপড়া জানতেন (অতি অল্প সংখ্যক) তারা বিচ্ছিন্নভাবে হাদীস লিখে নিজ সংগ্রহে রেখে দিতেন, এমন প্রমাণ উপস্থিত আছে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেও রাসূল (সা.) বিভিন্ন সাহাবীর দ্বারা লিখিয়ে নিতেন। তবে রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় যেখানে কুরআন সংকলিত হয়নি সেখানে হাদীস সংকলিত হওয়ার প্রশ্ন আসে না।
মোটকথা রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় হাদীস সংরক্ষণের প্রধান উপায় ছিল মুখস্থকরণ এবং হাদীস প্রচারের প্রধান বা একমাত্র উপায় ছিল মৌখিক প্রচার। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের সময় সাহাবীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১,১৪,০০০ (এক লাখ চৌদ্দ হাজার)। এই ১,১৪,০০০ সাহাবীর সকলের পে সব সময় রাসূল (সা.) কাছে থেকে তাঁর সকল কথা শুনা বা সকল কাজ দেখা সম্ভব ছিল না। তাই অধিকাংশ সাহাবীর জানা থাকা হাদীসের মধ্যে কিছু ছিল রাসূল (সা.) এর নিকট থেকে সরাসরি শুনা বা দেখা আর কিছু ছিল অন্য সাহাবীর (রা.) নিকট থেকে শুনা বা দেখা। এ দুয়ের অংশ এক এক সাহাবীর জন্যে এক এক রকম ছিল।
খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় পর্যন্ত হাদীস সংরণ সংকলন ও প্রচার পদ্ধতি
রাসূল (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন ততোদিন কারো পক্ষে তাঁর নামে মিথ্যা কথা প্রচার করা, রাসূলের কথাকে তাঁর কথা নয় বলে উড়িয়ে দেয়া এবং রাসূল (সা.) এর কোন কথার অপব্যাখ্যা করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ ছিল না। কারণ, তেমন কিছু ঘটলেই সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূল (সা.) এর নিকট জিজ্ঞাসা করে সহজেই তার সমাধান করে নিতে পারতেন। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন ঘটে। একদিকে ওহীর জ্ঞান লাভের সূত্র ছিন্ন হয়ে যায় অন্যদিকে অনেক নও-মুসলিম ইসলাম পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়। কিছু মুনাফিকও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা রাসূল (সা.) এর নামে মিথ্যা হাদীস রচনা করারও চেষ্টা করে।
প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ঐ মুনাফিক মুরতাদদের কঠোর হস্তে দমন করেন। হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কড়াকড়ি আরোপ করেন। বর্ণিত কোন হাদীসের সত্যতা প্রমাণিত না হওয়ার আগে তিনি তা গ্রহণ করতেন না। তবে তিনি যে কুরআনের পরেই হাদীসের গুরুত্ব দিতেন তা স্পষ্ট বুঝা যায় খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর দেয়া প্রথম ভাষণ থেকে। সেখানে তিনি বলেছিলেন-
يَاَيُّهَا النَّاسُ قَدْ وُلِّيْتُ اَمْرَكُمْ وَلَسْتُ بِخَيْرِكُمْ وَلَكِنْ نَزَلَ الْقُرْآنُ وَسَنَّ النّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ السُّنَنَ فَعَلَّمَنَا فَعَلِمْنَا.
অর্থ: হে লোকগণ, আমাকে তোমাদের (রাষ্ট্রের) দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে অথচ আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। কিন্তু কুরআন নাযিল হয়েছে এবং নবী করীম (সা.) তাঁর সুন্নাত ও আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তিনি আমাদের এই উভয় জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন এবং আমরা তা শিখে নিয়েছি। (طبقات ابن سعد ج-৩، ص-১২৯) আবু বকর সিদ্দীক (রা.) নিজে ৫০০ (পাঁচশত) হাদীসের এক সংকলন তৈরি করেছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ ভাগে তিনি নিজেই তা নষ্ট করে দেন। এর কারণ হিসেবে মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ দু’টি বিষয় উল্লেখ করেছেন-
১. তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন যে, তাঁর সংকলিত হাদীসে একটি শব্দও যদি রাসূল (সা.) এর মূল বাণীর বিন্দুমাত্র বিপরীত হয়ে পড়ে তবে রাসূল (সা.) এর সতর্কবাণী অনুযায়ী তাঁকে জাহান্নামের ইন্ধন হতে হবে।
২. তাঁর মনে এ ভয়ও জাগ্রত হয় যে, তাঁর সংকলিত হাদীস গ্রন্থকে মুসলিম জনগণ, যদি কুরআনের সমতুল্য মর্যাদা দিয়ে বসে বা অন্য সাহাবীগণের বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অধিক মর্যাদা দিতে শুরু করে, তা হলে ইসলামের বিশেষ তি হবে।
দ্বিতীয় খলীফা ওমর ফারুক (রা.) এর দৃষ্টিতেও ইসলামের ভিত্তি হিসেবে কুরআনের পরই ছিল সুন্নাহ তথা রাসূল (সা.) এর হাদীসের স্থান। তিনি অনেক হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন শাসকের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং সর্বসাধারণ্যে সে সবের ব্যাপক প্রচার করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। ইলমে হাদীসের শিক্ষা ব্যাপকতর করার জন্যে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও করেন। কিন্তু জাল হাদীসের মারাত্মক কুফল থেকে মুসলমানদের রা করার জন্যে তিনিও আবু বকর (রা.) এর ন্যায় হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করেন। আবু মুসা আশআরী (রা.) এর বর্ণিত একটি হাদীসের সত্যতা প্রমাণের জন্যে তিনি তাঁকে বলেছিলেন-لَتَاْتِيْنِىْ عَلَى ذَلِكَ بَيِّنَةٌ اَوْ لَاَفْعَلَنَّ بِكَ.
অর্থ: দলিল পেশ কর নইলে তোমাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।(تذكرة الحفاظ ج-১، ص-৮. الحديث و المحدثون ص-৮০)
পরে তার সমর্থনে অপর এক সাহাবীকে পেশ করা হলে তিনি আশ্বস্ত হন।
হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর সময়ই বিচ্ছিন্ন থাকা হাদীস সম্পদ সংকলন করার প্রশ্ন প্রথম উত্থাপিত হয়। ওমর (রা.) নিজেই এ বিরাট কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি নিয়ে অন্যান্য সাহাবীর সাথে পরামর্শ করেন। মুসলমানরা তাঁর অনুকূলেই পরামর্শ দেন। কিন্তু পরে তাঁর নিজের মনে এ সম্পর্কে দ্বিধা ও সন্দেহ উদ্রেক হওয়ায় এক মাস ধরে চিন্তা-ভাবনা ও ইস্তেখারা করেন। শেষে তিনি নিজেই একদিন বললেন-
اِنِّىْ كُنْتُ ذَكَرَتُ لَكُمْ مِنْ كِتَابَةِ السُّنَنِ مَا قَدْ عَلِمْتُمْ. ثُمَّ تَذَكَّرْتُ فَاِذَا اُنَاسٌ مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ قَبْلَكُمْ قَدْ كَتَبُوْا مَعَ كِتَابِ اللهِ كُتُبًا فَاَكَبُّوْا عَلَيْهَا وَتَرَكُوْا كِتَابَ اللهِ وَ اَنِّىْ وَاللهِ لاَ اُلَبِّسُ كِتَابَ اللهِ بِشَيْءٍ فَتَرَكَ كِتَابَ السُّنَنِ.
অর্থ: আমি তোমাদের হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কথা বলেছিলাম এ কথা তোমরা জান। কিন্তু পরে মনে হল তোমাদের পূর্বের আহলে কিতাবরাও এমনিভাবে নবীর কথা সংকলিত করে কিতাব রচনা করেছিল এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করেছিল। আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিছুই মিশাবো না। অতঃপর তিনি হাদীস সংকলিত করার সংকল্প ত্যাগ করেন।
(مقدمة تنوير الحوالك موطا امام مالك ص-২، تقيد العلم ص-১৫০، جامع بيان العلم:ج-১، ص-৬৪، طبقات ابن سعد: ج-৩، ج-১، ص-২.৬، كنـز العمال، العلى متفى الهند:ج-৫، ص-২২৯)
বস্তুত সুসংবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস গ্রন্থ পেয়ে লোকেরা হয়তো কুরআন থেকে তাকে বেশি গুরুত্ব দিবে এবং কেবল হাদীস অনুযায়ীই চলতে শুরু করবে, শুধুমাত্র এ ভয়েই ওমর (রা.) হাদীস সংকলনের কাজ পরিত্যাগ করেন। তিনি এটাকে যে নাজায়েয মনে করতেন না, তা তাঁর পূর্বোল্লিখিত কার্যকলাপ থেকে সহজে জানা ও বুঝা যায়।
হজরত উসমান (রা.) এর বর্ণনা করা হাদীসের সংখ্যা কম থাকার বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য হচ্ছে-
مَا يُمْنِعُنِىْ اَنْ اُحَدِّثَ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنْ لاَ اَكُوْنَ اَوْعَى اَصْحَابِهِ عَنْهُ وَلَكِنِّىْ اَشْهَدُ لَسَمِعْتُهُ يَقُوْلُ مَنْ قَالَ عَلَى مَالَمْ اَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
অর্থ: রাসূল (সা.) এর সাহাবীদের মধ্যে আমি কম হাদীস জানি এটি রাসূল (সা.) এর হাদীস বর্ণনা থেকে আমার বিরত থাকার কারণ নয়। আসল কারণটি হচ্ছে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি নিজেই রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, আমি যা বলিনি যদি কেউ তা আমার কথা হিসেবে বর্ণনা করে তবে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়। (طبقات ابن سعد-৩، ق اول، ص-৩৯، مسند امام احمد: ج-১، ص-২৫) তাই হজরত উসমান (রা.) এর বর্ণনা করা কয়েকটি মাত্র হাদীস পাওয়া যায়।
হজরত আলী (রা.) হচ্ছেন সে কজন সাহাবীর মধ্যে এমন যাঁরা নিজ হাতে রাসূল (সা.) এর হাদীস লিখে রেখেছিলেন। তাঁর লিখিত হাদীস ভাঁজ করে তিনি তাঁর তলোয়ারের খাপে রেখে দিয়েছিলেন। (বুখারী, মুসনাদে আহমদ)
সাহাবীদের যুগ প্রায় শেষ হওয়া পর্যন্ত (১ম হিজরী শতকের শেষ পর্যন্ত) হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
খুলাফায়ে রাশেদার শেষ পর্যায়ে মুসলিম সমাজে নানাবিধ ফেতনার সৃষ্টি হয়। শিয়া ও খাওয়ারিজ দু’টি বাতিল ফিরকা স্থায়ীভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা হাদীস বানিয়ে রাসূল (সা.) এর নামে চালিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করে। তাই হাদীস পেলে মুনাফিকরা তা বিকৃত করে প্রচার করে ক্ষতি করতে পারে বা মুসলমানরা কুরআন বাদ দিয়ে হাদীসের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়তে পারে এসব কারণে সাহাবায়ে কিরামগণ সাধারণভাবে হাদীস বর্ণনা ও প্রচার সাময়িকভাবে প্রায় বন্ধ রাখেন। শরীয়াতের মাসলা-মাসায়েলের মীমাংসা কিংবা রাষ্ট্র শাসন ও বিচার-আচার প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে যখন হাদীসের আশ্রয় গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ত কেবলমাত্র তখন তারা পরস্পরের নিকট হাদীস বর্ণনা করতেন। তবে এ সময় হাদীসের বিরাট সম্পদ ধারণ করে অসংখ্য সাহাবী অতন্দ্র প্রহরীর মত উপস্থিত ছিলেন।
দিন যত যেতে থাকে মুসলিম সমাজে তত নিত্য নতুন পরিস্থিতি ও সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। মুসলিম জনসাধারণের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূল (সা.) এর কথা জানা জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে জীবিত সাহাবীগণ তাদের জানা থাকা হাদীস বর্ণনা করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে ইলমে হাদীস অর্জন করার প্রবল আগ্রহ জন্মে। তারা সাহাবীদের নিকট নানাভাবে রাসূল (সা.) এর হাদীস শুনার আবদার শুরু করেন। এ কারণেও সাহাবায়ে কিরাম তাদের স্মরণে বা লিখা থাকা হাদীস প্রকাশ করতে এবং শিক্ষা দিতে প্রস্তুত হন। এ সময়ে বহু তাবেয়ী, সাহাবীদের নিকট থেকে হাদীস লিখে তা সংরক্ষণ ও প্রচারে লিপ্ত হন। হাদীস যথাযথভাবে গ্রন্থাকারে সংরক্ষণের কাজ এ পর্যায়ে কেউ করেছেন বলে ইতিহাসে কোন নজীর পাওয়া না গেলেও হাদীসের যে সকল লিখিত দলিল উপস্থিত থাকার কথা ইতিহাস থেকে জানা যায় তার কয়েকটি হচ্ছে-
১. সহীফায়ে সাদেকা-হজরত আবদুল্লাহ আমর ইবনুল আস (রা.)
এর লিখিত দস্তাবেজ। (ইন্তেকাল ৬৩ হিজরী)
২. সহীফায়ে হজরত আলী (রা.)
৩. রাসূল (সা.) এর লিখিত ভাষণ
৪. সহীফায়ে হজরত জাবির (রা.)
৫. সহীফায়ে সহীহা
৬. সহীফায়ে আনাস ইবনে মালেক (রা.)
৭. মাকতুবাতে নাফে (রহ.)
মোটকথা সাহাবীগণের সময়কাল প্রায় শেষ হওয়া পর্যন্ত (সর্বশেষ সাহাবী ইন্তেকাল করেন ১১০ হিঃ সনে) হাদীস সংরক্ষণের প্রধান উপায় ছিল মুখস্থ রাখা। আর হাদীস প্রচারের প্রধান উপায় ছিল মৌখিক প্রচার। একজন সাহাবী অন্য একজন সাহাবী বা একজন তাবেয়ী একজন সাহাবীর নিকট থেকে সরাসরি রাসূল (সা.) এর হাদীস শুনার জন্যে অকল্পনীয় কষ্ট করে অনেক দূর ভ্রমণ করেছেন, এমন ঘটনা প্রচুর পরিমাণে হাদীসগ্রন্থে ও ইতিহাসে উপস্থিত আছে।
হিজরী ১ম শতকের শেষ থেকে ২য় শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
এ সময়কালে তাবেয়ীদের এক বিরাট দল হাদীস সংগ্রহ, লিখন ও প্রচারের কাজে লেগে যায়। তাবেয়ী হচ্ছেন সেই মুমিনগণ যারা জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর কোন সাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কিছু সময় তাঁর সাথে কাটিয়েছেন এবং ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন। একমাত্র হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর নিকট ৮০০ (আটশত) তাবেয়ী হাদীস শিা লাভ করেছেন। সাহাবীগণ যেমন রাসূল (সা.) এবং পরস্পরের নিকট থেকে হাদীস শিা লাভ করেছেন, হাজার হাজার তাবেয়ী তেমনি সাহাবী ও অপর তাবেয়ীর নিকট থেকে হাদীস শিখেছেন। সাইদ ইবনে মুসাইয়্যাব (মৃঃ ৯৩ হিঃ), ইবনে শীরীন (মৃঃ ১১০ হিঃ), নাফে (মৃঃ ১১৭ হিঃ), ইমাম জয়নুল আবেদীন, মুজাহিদ, মাসরুক, মাকহুল (মৃঃ১১৮ হিঃ), ইকরামা (মৃঃ১০৫ হিঃ), আতা (মৃঃ১১৫ হিঃ), কাতাদাহ (মৃঃ ১১৭ হিঃ), ইমাম শাবী (মৃঃ ১০৫ হিঃ), আলকামা, ইব্রাহীম নখঈ (মৃঃ ৯৬ হিঃ), ওমর বিন আবদুল আজিজ (মৃঃ ১০১ হিঃ) প্রমুখ প্রবীণ তাবেয়ীগণের প্রায় সকলে ১০ম হিজরীর পর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৮ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন। অন্যদিকে সকল সাহাবী ১১০ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন। তাই সহজেই বুঝা যায়, তাবেয়ীগণ সাহাবীগণের দীর্ঘ সাহচার্য লাভ করেছেন।
তাবেয়ী হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (জন্ম ৬১ হিঃ, মৃত্যু ১০১ হিঃ), ৯৯ হিজরী সালে খলিফা নির্বাচিত হন। তাঁর খিলাফতের মেয়াদ ছিল দুই বছর পাঁচ মাস। ঈমান, তাকওয়া ও যোগ্যতার কারণে তিনি ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে ইসলামী জীবন-যাপন ও খিলাফত পরিচালনার জন্যে হাদীস এক অপরিহার্য সম্পদ। সাহাবায়ে কিরামের প্রায় সকলে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। অধিকাংশ তাবেয়ীও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন তারাও আর বেশি দিন থাকবেন বলে মনে হয় না। অতএব অনতিবিলম্বে এই মহান সম্পদ সংগ্রহ ও সংকলন একান্ত দরকার। এটি ভেবেই তিনি ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে নিম্নোক্ত ফরমান লিখে পাঠান-
اُنْظُرْحَدِيْثَ رَسُوْلِ اللهِ (ص) فَاجْمِعُوْا.
অর্থ: রাসূল (সা.) এর হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দাও। তা সংগ্রহ-সংকলন কর।
(فتح البارى، الموطا مالك ص-২)
মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি আবু বকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হাযমকেও তিনি নিম্নোক্তভাবে ফরমান লিখে পাঠান-
اُنْظُرْ مَاكَانَ مِنْ حَدِيْثِ رَسُوْلِ اللهِ (ص) اَوْ سُنَّتِهِ اَوْ حَدِيْثِ عُمَرَ اَوْنَحْوِ هَذَا فَاكْتُبْهُ لِىْ فَاِنِّىْ خِفْتُ دُرُوْسَ الْعِلْمِ وَ ذِهَابِ الْعُلَمَاءِ.
অর্থ: রাসূল (সা.) এর হাদীস বা তাঁর সুন্নাহ অথবা হজরত ওমরের বাণী কিংবা অনুরূপ যা কিছু পাওয়া যায় তার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্যে লিখে নাও। কেননা আমি হাদীস সম্পদের ও ইলমে হাদীসের ধারকদের বিলুপ্তির ভয় পাচ্ছি।
(موطا امام محمد، بخارى، طبقات ابن سعد، سنن الدارمى)
তিনি আরও লিখেন-
وَلاَ يُقْبَلُ اِلاَّ حَدِيْثَ النَّبِىِّ (ص) وَلِيَفْشُوْا الْعِلْمَ وَ لِيُجْلِمُوْا حَتَّى يُعْلَمَ فَاِنَّ الْعِلْمَ لاَ يَمْلِكُ حَتَّى يَكُوْنَ سِرَّ.
অর্থ: আর রাসূল (সা.) এর হাদীস ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ কর না। লোকেরা যেন ইলমে হাদীসকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে এবং হাদীস শিা দানের জন্যে মজলিস করে। যেন যারা জানে না তারা শিখে নিতে পারে। কারণ, জ্ঞান গোপন করলে তা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। (বুখারী ১ম খণ্ড)
ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাবেয়ী ইমাম জুহরীকে বিশেষভাবে হাদীস সংকলনের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।
(الجامع بيان العلم، طبقات ابن سعد:ص-৩৩৬، تنوير الحوالك شرح الموطا مالك)
ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের ফরমান জারি করার পর বেশি দিন জীবিত ছিলেন না (মৃত : ১০১ হিঃ)। কিন্তু তাঁর ফরমানের ফলে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের যে প্রবাহ শুরু হয়েছিল তা পরের কয়েকশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাবেয়ীগণ বিভিন্ন শহরে উপস্থিত থাকা সাহাবী বা তাবেয়ীদের নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহের জন্যে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতেন।
তাবেয়ী যুগে হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের যে ক্রমপদ্ধতি ছিল তার সংপ্তিসার হল-
اَوَّلُ الْعِلْمِ الإسْتِمَاعُ ثُمَّ الإنْصَاتُ ثُمَّ الْحِفْظُ ثُمَّ الْعَمَلُ ثُمَّ النَّشْرُ.
অর্থ: প্রথমে শ্রবণ করা হতো, পরে তাতে মনোযোগ দেয়া হত, তারপর মুখস্থ করা হত, অতঃপর সে অনুযায়ী আমল শুরু হত এবং তারপর তা প্রচার করা হত। (جامع بيان العلم، ص-১১৮)
অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামদের যুগের ন্যায় তাবেয়ী যুগেও হাদীস সংরণ ও প্রচারের প্রধান উপায় ছিল মুখস্থকরণ ও মৌখিক প্রচার।
হিজরী ২য় শতকের শুরু থেকে কনিষ্ঠ তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীনদের এক বিরাট দল সাহাবা ও প্রবীণ তাবেয়ীদের লিখিত হাদীসগুলো ব্যাপকভাবে একত্রিত করতে থাকেন। খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) এর সরকারি ফরমান এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ যুগেই ইমাম আবু হানীফা (রা.) কর্তৃক কিতাবুল আসার নামক একটি হাদীস গ্রন্থ সংকলিত হয়। মুসলিম উম্মতের নিকট উপস্থিত থাকা হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সর্বাধিক প্রাচীন গ্রন্থ। ইমাম আবু হানীফার পূর্বে বিছিন্নভাবে অনেকের দ্বারা হাদীস সংগৃহীত ও লিখিত হয়েছিল কিন্তু ঠিক গ্রন্থ প্রণয়নের ধারায় হাদীসের কোন গ্রন্থ সংকলিত হয় নাই। কিতাবুল আসার-এর পরপরই সংকলিত হয় ইমাম মালিক (রহ.) এর মুয়াত্তা।
প্রসিদ্ধ কয়েকজন তাবে-তাবেয়ীন হচ্ছেন-ইমাম আবু হানীফা (জন্ম ৮০ হিঃ), ইমাম মালিক (৯৩-১৭৯ হিঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (মৃঃ ১৮৩ হিঃ), ইমাম মুহাম্মাদ শায়বানী, ইমাম আওয়ায়ী (মৃঃ ১৫৭ হিঃ), ইমাম শুবা, ইমাম সুফিয়ান সওরী (৯৭-১৬১ হিঃ), ইমাম লাইস ইবনে সায়াদ (৯৪-১৬৫ হিঃ), সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (১০৭-১৯৮ হিঃ), ইমাম ইবনে জুরাইজ (৮০-১৫০ হিঃ), ইবনে আমের।
হিজরী ২য় শতকের মাঝামাঝি থেকে ৪র্থ শতকের শেষ পর্যন্ত হাদীস সংরণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
এ যুগে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিভিন্ন দিক দিয়ে ব্যাপকতা লাভ করে। এ যুগের প্রসিদ্ধ কাজগুলো হচ্ছে-
১. মুসনাদ প্রণয়ন
তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথম ভাগে মুসনাদ নামক হাদীস গ্রন্থ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। মুসনাদ বলা হয় সেই ধরনের হাদীস গ্রন্থকে যেখানে এক একজন সাহাবীর বর্ণনা করা সকল হাদীস বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রিত করে উল্লেখ করা হয়। এখানে হাদীস সহীহ কি সহীহ না, সেদিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া হত না। যেমন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হতে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সনদ সূত্রে যত হাদীস গ্রন্থকার মুহাদ্দিসের নিকট পৌঁছেছে, সহীহ কি সহীহ নয় সেদিকে বেশি দৃষ্টি না দিয়ে, সনদ উল্লেখপূর্বক, মুসনাদে আবু বকর সিদ্দিক শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করা, মুসনাদ গ্রন্থ প্রণয়ন করার রীতি। এ ধরনের গ্রন্থ প্রণয়ন দোষমুক্ত না হলেও এতে যে কল্যাণ আছে তা স্বীকার করতেই হবে।
কয়েকটি প্রসিদ্ধ মুসনাদ গ্রন্থের নাম গ্রন্থকারের ইন্তেকালের হিজরী সনসহ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
মুসনাদ উবায়দুল্লাহ ইবনে মুসা (মৃ. ২১৩ হিঃ), মুসনাদুল হুমায়দী (মৃঃ ২১৯ হিঃ), মুসনাদ ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), মুসনাদ উসমান ইবনে আবু শায়বাহ (মৃঃ ২৩৯ হিঃ), মুসনাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (জন্ম ১৬৪ হিঃ, মৃঃ ২৪১ হিঃ), আল মুসনাদুল কবীর কুরতবী (মৃ ২৭৬ হিঃ), মুসনাদ আবু দাউদ তায়ালিমী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)।
২. আসমা-উর-রিজাল এবং হাদীস পর্যালোচনা ও সমালোচনা বিজ্ঞান প্রণয়ন
তৃতীয় হিজরী শতকে একদিকে মুহাদ্দিসগণ জলে-স্থলে ব্যাপক ভ্রমণ করে মুসলিম জাহানের প্রতি কেন্দ্রে যেমন তন্নতন্ন করে হাদীস খুঁজে বেড়াতে থাকেন অন্যদিকে তেমনি মুসলিম জাহানে নানাবিধ ফেতনার উদ্ভব হয় (বর্ণনা পরে আসছে)। ঐ ফেতনাসমূহের সাথে জড়িত প্রায় সকলেই নিজস্বভাবে কথা রচনা করে রাসূল (সা.) এর হাদীস বলে বর্ণনা করতে শুরু করে। প্রতিটি বর্ণনার সাথে মনগড়া বর্ণনাসূত্র (সনদ) এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয় যাতে মানুষ তাকে রাসূল (সা.) এর কথা বলে বিশ্বাস করতে সনদের দিক দিয়ে কোন সন্দেহে পতিত না হয়। এ কারণে প্রতিটি হাদীস, সমালোচনার কষ্টিপাথরে যাচাই করে কোনটি রাসূল (সা.) এর বাণী এবং কোনটি নয়, তা নির্ধারণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মেটাতেই আসমা-উর-রিজাল (হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবন বৃত্তান্ত) এবং হাদীস পর্যালোচনা, (علوم الجرح و التعديل) বিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটে। এভাবে হাদীস পরীা-নিরীা, যাচাই-বাছাই ও ছাঁটাইয়ের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ধারণকারী এক স্বতন্ত্র বিজ্ঞান, হাদীস শাস্ত্রে যৌক্তিক কারণেই স্থান লাভ করে।
(الحديث المحدثون গ্রন্থের ৩১৬-৩৪২ পৃষ্ঠার আলোচনার ছায়া অবলম্বনে)
হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচারের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বনু আব্বাসীয়দের বাদশাহ্ আল-মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ (২৩২ হিঃ) হাদীস সংরণ, সংকলন ও প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। অপরদিকে সংগ্রহ, বাছাই-ছাঁটাই ও সংকলনের পর সহীহ হাদীসের সমন্বয়ে উন্নত ধরনের গ্রন্থ প্রণয়নের কাজও তৃতীয় হিজরী শতকে বিশেষ গুরুত্ব, মর্যাদা, ব্যাপকতা ও গভীরতা সহকারে সুসম্পন্ন হয়। এ বিরাট ও দুরূহ কাজের জন্যে যে প্রতিভা ও দতা অপরিহার্য ছিল তাতে ভূষিত হয়েই আবির্ভূত হন-
১. ইমাম বুখারী (রহ). (১৯৪-২৫৬ হিঃ)
২. ইমাম মুসলিম (রহ.) (২০৪-২৬১ হিঃ)
৩. ইমাম নাসায়ী (রহ.) (২১৫-৩০৩ হিঃ)
৪. ইমাম আবু দাউদ (রহ.) (২০২-২৭৫ হিঃ)
৫. ইমাম তিরমিযী (রহ.) (২০৯-২৭৯ হিঃ)
৬. ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) (২০৯-২৭৩ হিঃ)
এই ছয়জন মহৎ ব্যক্তি যে হাদীস গ্রন্থ সংকলন করেন সেগুলোই হচ্ছে সর্বাধিক সহীহ হাদীস গ্রন্থ। এ গ্রন্থসমূহ ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও পঠিত। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে এমন কোন স্থান পাওয়া যাবে না যেখানে বুখারী শরীফ পাওয়া যাবে না। হাদীসের এ গ্রন্থসমূহ সংকলিত হওয়ার পর হাদীস সংরণ ও প্রচারের প্রথম ও দ্বিতীয় যুগের ধারা পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ মুখস্থ করার মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারের ধারা পরিবর্তন হয়ে পুস্তক বা গ্রন্থ আকারে সংরক্ষণ এবং পুস্তক পড়ার মাধ্যমে প্রচারের ধারা শুরু হয়ে যায় এবং তা দ্রুতগতিতে প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
হিজরী ৫ম শতক থেকে বর্তমান কাল (হিজরী ১৪৩০ বা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
এ সুদীর্ঘ সময়ে যে কাজ হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে-
১. হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের ভাষ্যগ্রন্থ, টীকা ও অন্যান্য ভাষায় তরজামা গ্রন্থ রচিত হওয়া।
২. হাদীসের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার উপর অসংখ্য গ্রন্থ এবং এ সব গ্রন্থের ব্যাখ্যা ও সার সংক্ষেপ রচিত হওয়া।
৩. বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তৃতীয় যুগের গ্রন্থাবলী থেকে নিজেদের আগ্রহ বা প্রয়োজনে হাদীস চয়ন করে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। এ ধরনের কয়েকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে-
ক. মিশকাতুল মাসাবীহ
সংকলক ওয়ালীউদ্দীন খতীব তাবরীযী। নির্বাচিত সংকলন-গুলোর মধ্যে এটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়। এখানে সিহা সিত্তার প্রায় সকল হাদীসসহ আরও দশটি মৌলিক গ্রন্থের হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে।
খ. রিয়াদুস-সালেহীন
সংকলক ইমাম আবু যাকারিয়া ইবনে শরফুদ্দিন নববী (মৃঃ ৬৭৬ হিঃ) এখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কুরআনের আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে।
গ. মুনতাকাল আখবার
ঘ. আত-তাগরীব ওয়াত তারহীব
ঙ. আল-মুহাল্লা
চ. মাসাবীহুস সুন্নাহ ইত্যাদি
৪. কম্পিউটার আবিষ্কার হওয়ার পর কম্পিউটার ডিসকের মাধ্যমে হাদীস সংরণ এবং ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে হাদীস প্রচারের কাজ শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
ভবিষ্যতে হাদীস সংগ্রহ
বিজ্ঞান যেভাবে প্রসার লাভ করছে তাতে মনে হয় সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন রাসূল (সা.) এর সকল কথা মহাশূন্য থেকে উদ্ধার করে সরাসরি তাঁর কণ্ঠে শুনা যাবে এবং তাঁর সকল কাজের ছবি মহাশূন্য থেকে উদ্ধার করে সরাসরি দেখা যাবে। সেদিন মানব সভ্যতা আবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির কথা, কাজ ও সমর্থন সরাসরি তাঁর নিকট থেকে জানতে পারবে। আর তখন একটি হাদীস প্রকৃতভাবে রাসূল (সা.) এর কথা, কাজ বা সমর্থন কিনা এ ব্যাপারে আর কোনই সন্দেহ থাকবে না।
হাদীসের বিভিন্ন অংশ
হাদীস শাস্ত্রে একটি হাদীসকে দু’টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-
১. সনদ (سند) তথা বর্ণনাকারীদের ধারা বা পরস্পরা এবং
২. মতন (متن) তথা বক্তব্য বিষয়।
চলুন এখন এই সনদ ও মতন সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক-
সনদ (سند) সম্বন্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
হাদীসের এ অংশে থাকে রাসূল (সা.) থেকে শুরু করে যে সকল ব্যক্তির মাধ্যমে হাদীসখানি গ্রন্থকার মুহাদ্দিসের নিকট পৌঁছেছে তাদের নাম। একটি হাদীসের বর্ণনা সূত্রে তথা সনদে মধ্যবর্তী লোকের সংখ্যা যত কম হবে ততো হাদীস বর্ণনায় অনিচ্ছাকৃত তথা মানবীয় ভুলের পরিমাণ কম এবং বর্ণনাকারীদের যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-পর্যালোচনা করা সহজ হয়। তাই বর্ণনাকারীদের স্তরের ভিত্তিতে হাদীসকে নিম্নোক্তভাগে ভাগ করা হয়েছে-
ক. ওয়াহদানিয়াত (وحدانيات)
যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রে রাসূল (সা.) ও গ্রন্থকারের মধ্যে এক স্তরের ব্যক্তি তথা শুধু সাহাবী রয়েছে।
খ. সুনায়ীয়াত (ثنايات)
রাসূল (সা.) ও গ্রন্থকারের মধ্যে যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রে দুই স্তরের তথা সাহাবী ও তাবেয়ী স্তরের বর্ণনাকারী রয়েছে।
গ. সুলাসীয়াত
যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রে রাসূল (সা.) ও গ্রন্থকারের মধ্যে তিন স্তর তথা সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী স্তরের বর্ণনাকারী রয়েছে।
বর্ণনাকারীদের স্তর সংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসসমূহের অবস্থান-
১. কিতাবুল আসার (ইমাম আবু হানিফা র. রচিত)
ওয়াহদানিয়াত – কয়েকটি; সুনায়ীয়াত – অনেকটি
২. মুয়াত্তা (ইমাম মালিক র. রচিত)
ওয়াহদানিয়াত – নাই; সুনায়ীয়াত অধিকাংশ
৩. সুনানে দারেমী (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. রচিত)
সুলাসীয়াত – ১৫ টি ; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট
৪. বুখারী শরীফ :
সুলাসীয়াত – ২২টি; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট
৫. ইবনে মাজাহ :
সুলাসীয়াত – ৫টি; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট
৭. আবু দাউদ :
সুলাসীয়াত – ১টি; বাকি সব – চার স্তর বিশিষ্ট
৮. জামে তিরমিযি
সুলাসীয়াত – ১টি; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট
৯. মুসলিম শরীফ :
সব হাদীস চার স্তর বিশিষ্ট।
১০. নাসায়ী :
সব হাদীস চার স্তর বিশিষ্ট।
.