হাদীস সংরক্ষণ

রসূল সা. এর যামানা থেকে হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এ অধ্যায় বিস্তৃত। এ যুগের হাদিস সংগ্রাহক, সংকলক ও সংরক্ষণকারীগণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপ :
১. আবু হুরায়রা রা. (আবদুর রহমান) : মৃত্যু ৫৯হি. বয়স ৭৮ বছর, হাদিস বর্ণনার সংখ্যা ৫৩৭৪। তাঁর নিকট থেকে হাদিস শিক্ষা গ্রহণকারীগণের সংখ্যা ৮০০ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. : মৃত্যু ৬৮হি. বয়স ৭১ বছর, হাদিস বর্ণনার সংখ্যা- ২৬৬০।
৩. আয়েশা সিদ্দীকা রা. : মৃত্যু ৫৮হি. বয়স ৬৮ বছর, হাদিস বর্ণনার সংখ্যা- ২২১০।
৪. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. : মৃত্যু ৭৩হি. বয়স ৮৪ বছর, হাদিস বর্ণনার সংখ্যা- ১৬৩০।
৫. জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. : মৃত্যু ৭৮হি. বয়স ৯৪ বছর, হাদিস বর্ণণার সংখ্যা- ১৫৬০।
৬. আনাস ইবনে মালেক রা. : মৃত্যু ৯৩হি. বয়স ১০৩ বছর, হাদিস বর্ণনার সংখ্যা ১২৮৬।
৭. আবু সাঈদ খুদরি রা. : মৃত্যু ৭৪হি. বয়স ৮৪ বছর। তাঁর হাদিস বর্ণনার সংখ্যা- ১১৭০।
এঁরা হলেন সেইসব মহান সাহাবী যাঁদের হাজারের অধিক হাদিস মুখস্ত ছিলো। এছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. মৃত্যু ৬৩হি.; আলী রা. মৃত্যু ৪০হি.; উমর রা. মৃত্যু ২৩হি. সেসব সাহাবীদের ক’জন যাদের বর্ণনা পাঁচশ থেকে হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে।
এমনি করে আবু বকর সিদ্দীক রা. মৃত্যু ১৩হি.; উসমান রা. মৃত্যু ৩৬হি.; উম্মে সালামা রা. মৃত্যু ৫৯হি.; আবু মূসা আশয়ারী রা. মৃত্যু ৫২হি.; আবুযর গিফারী রা. মৃত্যু ৩২হি.; আবু আইয়ুব আনসারী রা. মৃত্যু ৫১হি.; উবাই ইবনে কা’ব রা. মৃত্যু ১৯হি. এবং মুয়ায ইবনে জাবাল রা. মৃত্যু ১৮হি. সেসব সাহাবী যাঁরা একশ’ থেকে পাঁচশ’ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
এছাড়া এ যুগের কতিপয় সেরা তাবেয়ী রয়েছেন, হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাসে যাদের স্বর্ণোজ্জল ভূমিকা চির-ভাস্বর। এঁদের ক’জনের পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হলো:
১. সায়ীদ ইবনে মুসায়্যেব। উমর ফারূক রা.-এর খেলাফতের দ্বিতীয় বছর ইনি মদিনায় জন্ম গ্রহণ করেন। ১৩৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
উসমান, আয়েশা, আবু হুরায়রা এবং যায়েদ ইবনে সাবেত রা. থেকে তিনি হাদিসের শিক্ষা লাভ করেন।
২. উরওয়া ইবনে যুবায়ের। ইনি মদিনার শ্রেষ্ঠ আলেমদের একজন। তিনি উম্মুল মুমিনীন আয়েশার বোন আসমা বিনতে আবু বকর রা.-এর পুত্র। মুহতারামা খালা আয়েশা রা. থেকে তিনি অধিকাংশ হাদিস বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা রা. এবং যায়েদ ইবনে সাবিত রা. থেকেও তিনি হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেন।
সালেহ ইবনে কাইসান এবং ইমাম ইবনে শিহাব যুহরীর মতো বিজ্ঞ আলেমগণ ছিলেন তাঁর ছাত্র। ৯৪ হিজরিতে তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন।
৩. সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.। ইনি মদিনার প্রখ্যাত সাতজন ফকীহর একজন। পিতা আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেন। অন্যান্য সাহাবীগণ থেকেও তিনি হাদিসের শিক্ষা লাভ করেন। নাফে, যুহরি ও অন্যান্য মশহুর তাবেয়ীগণ ছিলেন তাঁর ছাত্র। ১০৬ হিজরিতে তিনি পরলোক গমন করেন।
৪. নাফে : ইনি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর আযাদকৃত গোলাম। ইবনে উমরের তিনি ছিলেন খাস শাগরেদ এবং ইমাম মালেকের ছিলেন তিনি উস্তাদ। মুহাদ্দিসগণের নিকট এ সনদ অর্থাৎ ‘মালেক-নাফে-আবদুল্লাহ ইবনে উমর-রসূলুল্লাহ সা.’ সোনালি সনদ (সূত্র) বলে গণ্য। ১১৭ হিজরিতে নাফে ইন্তেকাল করেন।
প্রথম অধ্যায়ে হাদিসের লিখিত সম্পদগুলো নিম্নরূপ :
০১. সহীফায়ে সাদিকা : এ সংকলনটি সংগ্রথিত করেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস্ রা.। মৃত্যু ৬৩হি., বয়স ৭৭ বছর।
লেখা ও সংকলনের কাজে তাঁর ছিলো দারুণ আগ্রহ। রসূল সা. থেকে যা কিছু শুনতেন, তিনি সবই লিখে রাখতেন। এ ব্যাপারে স্বয়ং রসূলুল্লাহ সা. তাকে অনুমতি প্রদান করেছিলেন। এটিতে প্রায় এক হাজার হাদিস সংগ্রথিত হয়েছে। সহীফাটি দীর্ঘদিন তাঁর খান্দানের হাতে সংরক্ষিত ছিলো। এ সবগুলো হাদিস মুসনাদে আহমদে সংকলিত হয়েছে।
০২. সহীফায়ে সহীহা : এটি সংকলন করেছেন হাম্মাদ ইবনে মুনাব্বাহ (মৃত্যু ১০১হি.)। ইনি আবু হুরায়রার একজন মশহুর ছাত্র। আবু হুরায়রার বর্ণনা সমূহ তিনি সংগ্রথিত করেন। তাঁর পান্ডুলিপি বার্লিন এবং দামেস্কের গ্রন্থাগারে মওজদু রয়েছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মুসনাদে এর সবগুলো হাদিস ‘আবু হুরায়রা’ শিরোনামে সংগ্রথিত হয়েছে। গত শতাব্দীতে সহীফাটি ড. হামিদুল্লাহর প্রচেষ্টায় মুদ্রিত হয়ে হায়দ্রাবাদ দক্ষিণ থেকে প্রকাশিত হয়। এতে মোট ১৩৮টি হাদিস রয়েছে।
এ সহীফাটি আবু হুরায়রার সমস্ত বর্ণনার একটা অংশ মাত্র। এর অধিকাংশ বর্ণনা সহীহ বুখারি ও এবং সহীহ মুসলিমে পাওয়া যায়।
০৩. আবু হুরায়রার আরেকজন শাগরেদ বশীর ইবনে নাহীফও কতিপয় হাদিস সংগ্রথিত করেন। শিক্ষাগ্রহণ শেষে তিনি সংকলনটি আবু হুরায়রাকে শুনিয়ে সত্যতা প্রমাণিত করে নেন।
০৪. মুসনাদে আবু হুরায়রা রা. : সাহাবাগণের যুগেই এটি লেখা হয়। মিশরের গভর্ণর উমর ইবনে আবদুল আযীযের পিতা আবদুল আযীয ইবনে মারওয়ানের (মৃত্যু-৮৬হি.) নিকট এর একটি কপি মওজুদ ছিলো।
তিনি কাসীর ইবনে মুররাহকে লিখেছেন, তোমার নিকট সাহাবায়ে কিরামের যেসব হাদিস রয়েছে, সেগুলো লিখে পাঠাও। তবে আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসমূহ পাঠানোর প্রয়োজন নেই। কারণ সেগুলো আমার নিকট মওজূদ রয়েছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার স্বহস্তে লিখিত মুসনাদে আবু হুরায়রার একটি কপি বর্তমানে জার্মানীর গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
০৫. সহীফায়ে আলী রা. : ইমাম বুখারির ব্যাখা ও বর্ণনা থেকে বুঝা যায় এ সংকলনটি যথেষ্ট বড় ছিলো। এতে যাকাত, মদীনার মর্যাদা, বিদায় হজ্জের ভাষণ এবং ইসলামি বিধান সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহ সংগ্রথিত ছিলো।
০৬. রসূল সা.-এর লিখিত বক্তৃতা : মক্কা বিজয়কালে রসূল সা. আবু শাহমা ইয়ামানীর আবেদনক্রমে তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতা লিখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতে মানবাধিকার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে।
০৭. সহীফায়ে জাবির রা. : জাবির ইবনে আবদুল্লাহর ছাত্র ওহাব ইবনে মুনাববাহ (মৃত্যু ১১০হি.) ও সুলাইমান ইবনে কায়েস লশকরী তাঁর বর্ণনাসমূহকে সংগ্রথিত করেন। এতে লিপিবদ্ধ ছিলো হজ্জের নিয়ম-কানুন ও বিদায় হজ্জের ভাষণ সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহ।
০৮. উম্মুল মুমিনীন আয়েশার বর্ণনা সমূহ : আয়েশা রা.-এর বর্ণনাসমূহ তাঁর শারগেদ ও বোনপো উরওয়া ইবনে যুবায়ের লিপিবদ্ধ করে নিয়েছিলেন।
০৯. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদিস সমূহ : ইবনে আব্বাসের রা. বর্ণনাসমূহের কয়েকটি সংকলন ছিলো। তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে জুবায়ের তাঁর বর্ণনাসমূহ লিপিবদ্ধ করেন।

১০. সহীফায়ে আনাস ইবনে মালেক : সায়ীদ ইবনে হেলাল বলেন, আনাস রা. তাঁর লিখিত হাদিস সমূহ বের করে আমাদের দেখাতেন এবং বলতেন এসব হাদিস আমি স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ সা. থেকে শুনে লিখে নিয়েছি।
১১. আমর ইবনে হাযম : রসূলুল্লাহ সা. তাঁকে ইয়েমেনের গভর্ণর নিযুক্ত করে পাঠাবার সময় একটি লিখিত নির্দেশনামা প্রদান করেন। আমর এ নির্দেশনামা শুধু সংরক্ষণই করেননি, বরঞ্চ তার সাথে রসূলে করিম সা.-এর আরো ২১টি ফরমান যুক্ত করে একটি সুন্দর গ্রন্থ তৈরি করে নিয়েছিলেন।
১২. রিসালায়ে সামুরা ইবনে জুনদুব : উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পুত্র এটি লাভ করেছিলেন। এতে অনেকগুলো বর্ণনা গ্রন্থাবদ্ধ ছিলো।

৩. সহীফায়ে সাআদ ইবনে উবাদাহ : ইনি রসূলের একজন সাহাবী ছিলেন। জাহেলি যুগ থেকেই তিনি লেখা পড়া জানতেন।
১৪. মাকতুবাতে নাফে : সুলাইমান ইবনে মূসা বর্ণনা করেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে তাঁর গোলাম নাফে হাদিস শুনে শুনে লিখে রাখতেন।
১৫. মায়ান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের পুত্র আবদুর রহমান আমার সামনে কিতাব হাতে নিয়ে হলফ করে বলেছেন: এটা আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের নিজ হাতে লেখা হাদিসের কিতাব।